হাফিজ রশিদ খানের সাক্ষাৎকার

মস্তিষ্কই তো নতুন-নতুনতর পথের সৃষ্টিকর্তা

হাফিজ রশিদ খান
হাফিজ রশিদ খান, ২০১৩। ছবি: সিসি-বাই-এসএ ৪.০
হাফিজ রশিদ খান, ২৩ জুন ১৯৬১, চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ ও শামসুর রাহমানের মতোন পষ্ট কাব্যভাষার আরেক কবি তিনি। বাঙলা কবিতাঙ্গনে আদিবাসী প্রসঙ্গের মতোন একটি নবমাত্রার সফল যোগানদার, আদিবাসী আত্মপরিচয়দানকারী এবং উত্তর-উপনিবেশবাদের (Neo-Colonialism) দার্শনিক প্রবক্তা। শুধু তাই নয়, তিনি নতুন চিন্তা তথা তারুণ্যের বিস্ফোরণোন্মুখ মতায় সদা আস্থাশীল রয়েছেন বলেই একবিংশশতাব্দির প্রথম দশকে হাজির-হওয়া দৃষ্টান্তবাদী সাহিত্য আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে দ্বিধাবোধ করেন নি বিন্দুমাত্র।
তরুণপ্রিয়, তরুণদের প্রিয়; শক্তিমান এই কবির পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তি ঘটেছে গত ২৩ জুন ২০১১-তে। আমরা, সাধারণ জীবনযাত্রার অনেক সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করে ২৫ বছরেরও অধিক সময় ধরে নিরলসভাবে সাহিত্যনিমগ্ন থাকা কবি হাফিজ রশিদ খানের দীর্ঘকাব্যস্বর্ণময় জীবন আশা করছি।

প্রত্যালীঢ়-এর পক্ষে সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন:
মহীন রীয়াদ, সম্পাদিত কাগজ: শঙ্খবাস (২০০৯-২০১০)
ফয়সল অর্দ্রী, সম্পাদিত কাগজ: শঙ্খবাস (২০০৯-২০১০)
রাফায়েল রাসেল, সম্পাদিত কাগজ: চেরাগীআড্ডা (২০১৩)

প্রত্যালীঢ় : হাফিজ দা, সাহিত্যাঙ্গনে আপনার আবির্ভাব গত শতাব্দির ৮-এর দশকে। আপনার পরিপূর্ণ বিকাশ ৯-এর দশকে। আমরা আদিবাসী কাব্য ১৯৯৭-এ পেলাম। ঐ ৮-এর দশকে আরো অনেকের আবির্ভাব ঘটেছে, কেউ-কেউ এখনো সক্রিয় রয়েছেন। বলুন তো, সবার থেকে আপনাকে পৃথক করার উপায় কী? হাজার বছরের বাঙলাসাহিত্যে নতুন কিছু যোগ করতে পেরেছেন বলে মনে করেন কি?

জোসনা কেমন ফুটেছে (১৯৮২), হাফিজ রশিদ খান
জোসনা কেমন ফুটেছে (১৯৮২)

হাফিজ রশিদ খান : মুক্তিযুদ্ধোত্তর কৈশোরিক আনন্দ-বেদনার আবহে আমার লেখালেখি শুরু। প্রথমে অন্ত্যমিলযুক্ত ছড়াজাতীয় লেখায় খাতা ভরিয়ে ফেললেও ওগুলোর সামান্যই প্রকাশের মুখ দেখেছে। সে সময় রবীন্দ্র-নজরুলের গান-কবিতা, সুকান্ত, জসীমউদ্দীনের পদ্য ইত্যাদির পারিবারিক আবহে অন্ত্যমিলযুক্ত ছড়ার পাশাপাশি কবিতাও লিখতে থাকি। আরো গম্ভীর, আরো গভীর ভাবের জগতে বিচরণ শুরু হয় জীবনানন্দ পাঠের পর। রবীন্দ্রসঙ্গীতেও এ-সময় আমার গভীর নিমজ্জন হয়। সে কারণে রবীন্দ্রপ্রভাবিত বেশ কিছু কবিতা লিখে ফেলি। আমার সে সময়কার বন্ধুরা, যেমন: শফিকুর রহমান, মোহাম্মদ বখতিয়ার, রাশেদ মাহমুদ, প্রয়াত কাজী আইয়ুব, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, মাহফুজুল হক চৌধুরী কাঞ্চন, রাহগীর মাহমুদ-দের উৎসাহে প্রথম কাব্য জোসনা কেমন ফুটেছে (১৯৮২)-এর পাণ্ডুলিপি তৈরি করে তা প্রকাশের তোড়জোড়ে নেমে পড়ি। পাণ্ডুলিপির নামকরণেও রবীন্দ্রপ্রভাব সুস্পষ্ট- জোসনা কেমন ফুটেছে। শুধু ‘জোছনা’র জায়গায় ‘জোসনা’ ব্যবহার করি। এরপর আমার এক দুলাভাইয়ের আর্থিক সহযোগিতায় কাতালগঞ্জের আল আমিন প্রিন্টিং প্রেস থেকে পাণ্ডুলিপিটি মুদ্রিত আকারে বেরুলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। সেটি ১৯৮২-এর সেপ্টেম্বর। বিবিধ সমালোচনায় বিদ্ধ হল এ-কাব্য। তখন সিকদার আমিনুল হকের সম্পাদনায় বেরুতো সাপ্তাহিক বিপ্লব। ওখানে সেলিম হাসান নামে একজন গ্রন্থটিকে ‘জোড়াতালি দেয়া এক জোব্বা’-এর সঙ্গে তুলনা করলে মন খারাপ হয়ে যায়। আর লিখব না কবিতা- এ-রকম প্রতিজ্ঞা যখন নিয়ে ফেলেছি তখন দৈনিক দেশ নামের আরেক কাগজে কবি-চারুশিল্পী মাশুক হেলাল এ-কাব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাতে তরুণ, সম্ভাবনাময় কবি হিসেবে আমার প্রতি ছিল অভিনন্দন। এছাড়া সে কালের গণকন্ঠ, বাংলার বাণীর সাহিত্য পাতায়ও এ-কাব্যের তুমুল আলোচনা-সমালোচনা আমাকে কখনও উদ্দীপ্ত, কখনও-বা হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। বাংলার বাণীর সমালোচনাটার কথা একটু বিস্তারিত বলি। ওই পত্রিকার দু’পৃষ্ঠার সাহিত্যপাতার পুরো এক পৃষ্ঠা জুড়েই ছিল নিন্দা-মন্দের কাসুন্দি। একটু অবাকই হলাম, সমালোচকের নাম কোথাও খুঁজে না পেয়ে। পরে কবি আসাদ মান্নান, সে সময়ের তুখোড় কবি, আমার কিঞ্চিৎ অগ্রজ, দুটো তথ্য দিয়ে জানালেন, সাপ্তাহিক বিপ্লবের সেলিম হাসান আসলে কবি সিকদার আমিনুল হক আর বাংলার বাণীর ওই নামহীন সমালোচকটি কবি নির্মলেন্দু গুণ। যা হোক। এ-নিয়ে আমার অনুসন্ধিৎসা তখন ছিল না, এখনও নেই। তবে এসব সমালোচনা আমার ভারি উপকার করেছে। আমি আরও পঠন-পাঠনে মনোযোগী হয়েছি। আরো সনিষ্ঠ হয়েছি কবিতা রচনায়। ওই আশির দশকে চটিকাব্য বেরুলো ফুলবাড়িয়ার নিহত পলাশগুলি (১৯৮৪)। এরশাদ স্বৈরাচারের অপশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত ছাত্রদের মিছিলে ট্রাক উঠিয়ে কয়েকজনকে হত্যার প্রতিবাদে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আমার বন্ধুদের উদ্যোগে একই সালের (’৮৪) জানুয়ারিতে বেরুলো বিধ্বস্ত ক্যাম্পাস– প্রেমের কবিতার ভাঁজপত্র। মাত্র ১ টাকা মূল্যের এ-ভাঁজপত্র বিপুলভাবে সমাদৃত হয় এবং তরুণ সমাজে আমার কবিখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। আরেকটি তথ্য সম্প্রতি খুঁজে পেলাম এপিঠে-ওপিঠে ছাপা হওয়া আমার আরেক চটিকাব্য- সুন্দরের দুর্গ (১৯৮৩)। অপারাংশের কবি আবু মুসা চৌধুরী। ১৯৮৩-তেই বেরুলো চোরাগোপ্তা ডুবোপাহাড়, শিল্পী উত্তম সেনেরে প্রচ্ছদে। এ-কাব্যে সমাজ এবং পারিপার্শ্বিক অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু রাগী কবিতা ছিল। এছাড়া উৎসর্গপত্রের অভিনবত্বও অনেককে চটিয়ে দেয় : প্রিয় ভূখণ্ডের দুই মানচিত্র কবি শামসুর রাহমান/ কবি আল মাহমুদ। এটির প্রকাশক ছিলো আমাদের আড্ডার বন্ধু শফিকুর রহমান, মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ, রাশেদ মাহমুদ, প্রয়াত কবিবন্ধু সোহেল বাবরি, এখনকার অ্যাডভোকেট ফয়েজ উল্লাহ। শফিক তখন সদ্য ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকেছে। প্রকাশনা খরচা বাবদ প্রথম মাসের বেতন পেয়েই কড়কড়ে ৫০০ টাকা আমার হাতে দেয়ার সে দৃশ্য এখনো আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে। ১৯৮৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত হয় শোণিত প্রপাত নামে একটি দীর্ঘ কবিতার সংকলন। ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদ ও তৎকালিন উপনিবেশিক রাজনীতির ওপর কাব্যিক অভিপেক্ষ বলা যায় এটিকে। এ হল ৮-এর দশকে আমার কাব্যস্ফূর্তির বয়ান, সংক্ষেপে।

লোহিত ম্যান্ডোলিন (১৯৯১), হাফিজ রশিদ খান
লোহিত ম্যান্ডোলিন (১৯৯১)

এরপর ৯-এর দশকের শুরুতেই বের করলাম লোহিত ম্যান্ডোলিন (ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১)। শিল্পী ঢালী আল মামুন এই প্রথম ক্যানভাসের জগৎ ছেড়ে কোনো কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ করলেন। আমার আরেক সহৃদয় বন্ধু নূরুল আনোয়ার মাসুদ সে সময়ে এ-গ্রন্থের ব্যয়ভার বহন করে আমাকে অশেষ কৃতজ্ঞতা পাশে বেঁধে রেখেছে। এ-কাব্যের মধ্য দিয়ে আমার সুস্পষ্ট বাঁক পরিবর্তন লক্ষ করলেন অনেকে। কেননা এর অনেক কবিতায় আদিবাসীদের জীবনধারার প্রতিফলন ঘটেছে। উল্লেখ করা দরকার, ৯-এর দশকের শুরুতে ১৯৮৯-তে বাবার মৃত্যুর পর চাকরির প্রয়োজনে আমাকে পার্বত্য বান্দরবান জেলায় অবস্থান করতে হয়। তারও আগে বাবার কর্মসূত্রে এবং নিজের দুর্বার ভ্রমণেচ্ছার সুবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সমাজ আমার মনে এবং চেতনায় এক প্রত্যয়ের জন্ম দেয়। তা হল- এ-জীবনকে বাঙলা কবিতায় প্রবাহিত করা। আমি লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের কবিতায় এ-অনুষংগ একেবারেই অনুপস্থিত। ছিটেফোঁটা ভ্রমণ কাহিনি, পিকনিক বা হঠাৎ ঘুরে এসে হালকাচালের গদ্যেই এ জীবনধারার অনুরণন সীমিত ছিল। কিছু ব্রিটিশ প্রশাসক লেখক-গবেষক এবং দেশীয় আমলাদের কেউ কেউ এদের বিষয়ে কিছু গ্রন্থ রচনা করলেও, কবিতায় এ জীবন যেন অপোয় ছিল মুখর হতে। এ-পরিস্থিতিতেই ১৯৯৩ সালকে জাতিসংঘ ঘোষণা করল ‘আন্তর্জাতিক আদিবাসী বর্ষ’ হিসেবে। আমি এবং আমার কজন পাহাড়ি বন্ধু ও সুহৃদ, যেমন: শৈ অং প্রু, মংক্যশোয়ে নু নেভী, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া ঠিক করলাম পার্বত্য চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশের। সে এক দুর্মর অভিজ্ঞতা।

বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী  অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত (১৯৯৩), হাফিজ রশিদ খান
বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত (১৯৯৩)

অক্টোবর ১৯৯৩-তে বেরুল ওই গ্রন্থ আমার সম্পাদনায় বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসী : অংশীদারিত্বের নতুন দিগন্ত নামে। ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করল এ-বই। তিন মাসের মধ্যেই এর ১২০০ কপি বিক্রি হয়ে গেল। এ হল এক দিক। অন্যদিকে সে সময়কার সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আমার পিছু নিল। আমাকে শুলকবহরের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হল লালদিঘির পুলিশ সদর দপ্তরে। নানা জিজ্ঞাসাবাদ। আমি অকপটে ব্যক্ত করলাম আমার দৃষ্টিভঙ্গি। পুলিশের উপরের কর্মকর্তারা ছিলেন। এক সময় সন্তুষ্ট হয়ে তারা আমাকে মুক্তি দিলেন এ বলে যে, আমি যেন আর কখনও CHT নিয়ে লেখালেখি না করি ইত্যাদি। বস্তুত বৈষয়িক গদ্য তো আমার অভীষ্ট নয়। আমি আবার ফিরে এলাম কবিতায়। গভীর ও মর্মভেদী চেতনার আলোয় আমি পার্বত্য আদিবাসী জীবনধারাকে জানতে চাকরি ছেড়ে একেবারে বোহেমিয়ান হয়ে গেলাম। কবিতায় ফুটতে লাগলো ওই জীবনের নানাবর্ণের কথকতা। ওই সময়ে লেখা আদিবাসীকেন্দ্রিক কবিতাগুলো আমি তেমন ছাপতে দিই নি কোথাও। ১৯৯৩-১৯৯৬ পর্যন্ত এ পর্বের ২৯টি কবিতা রয়ে গেল আমার বালিশের নিচে, বইয়ের ভাঁজে, সিগারেটের প্যাকেটে। মাঝখানে তরুণ শিল্পী শাহীনুর রহমান, গল্পকার রাজীব নূর আর শিল্পী নজরুল ইসলাম বাবুর উদ্যোগে প্রকাশিত হল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের ৬টি কবিতার চটিবই স্বপ্নখণ্ডের রোকেয়া বেগম রুকু (১৯৯৫)। দেশের সে সময়কার উদ্ভট, অসহনীয় রাজনৈতিক প্রতিবেশ, সন্ত্রাস, ছিনতাই হত্যা নৈরাজ্যের ভেতর একজন সুলক্ষণা নারীর প্রতিভাসে আশাবাদী জীবনের স্বপ্নগাঁথা এ-কবিতাগুচ্ছ। প্রকাশসাল বাঙলা পহেলা বৈশাখ ১৪০২। শাহীনের প্রচ্ছদ ও ভেতরের নান্দনিক অলংকরণ। এও তরুণদের মন কেড়েছিল বেশ। অনেকে ওই কবিতাগুলোর পঙক্তি থেকে উচ্চারণ করে শোনাত আমাকে।

হাফিজ রশিদ খান ও মিল্লাতুন্নেছা খানম
হাফিজ রশিদ খান ও মিল্লাতুন্নেছা খানম

১৯৯৫-এ বিয়ে হল আমার বাঁশখালীর জলকদর খাল পারের কাথারিয়া গ্রামের মেয়ে মিল্লাতুন্নেছা খানমের সঙ্গে। দারুণ একরোখা এক ঘরোয়া নারী। আমি বিশুদ্ধ বেকার। কীভাবে খাই, কীভাবে চলি পথে- এখন ভাবলেও শিউরে উঠি। তবে আমাকে গোপনে খাদ্যাদি রসদ ইত্যাদি সরবরাহ করে বাঁচিয়ে রেখেছিল কেউ কেউ। হায় তারা কোথায়! অনেকের কথা মনেও নেই। যোগাযোগও নেই। সরাসরি নয়, অনেকে আবার দেখা করতে এসে হাসিখুশির আড্ডা, কবিতার কথা জানতে-জানতে, টেবিলে আমার পড়া চলছে- এমন বইয়ের ভাঁজে, আর কেউবা চোখে চোখ রেখে ওই বস্তু গছালে আমিও তো খুব খুশিই হতাম! ওদের সকলের মংগল হোক, প্রভু! ১৯৯৭-তে আমাদের প্রথম সন্তান এলো। নাইসা হাফিজ খান ঐচ্ছিক। ঠিক এ-সময়েই বান্দরবানের শৈ অং প্রু নানা কথার ফাঁকে আমার আদিবাসী কবিতাগুচ্ছের কথা জেনে ওটা প্রকাশের উদ্যোগ নিলেন। আদিবাসী কাব্য শিরোনামে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭-এ ওই কবিতাগুচ্ছ বেরুলো। উৎসর্গলিপিতে লিখলাম: নুরুন্নিসা বেগম, আমার মাকে। বলতে গেলে ওই ৯-এর দশকের শেষ দিককার সময়গুলোতে আমি একপ্রকার বন্ধ্যাই ছিলাম। চাকরির খোঁজে পাগলের মতো ঘুরেছি। বহু NGO কর্তা, যারা এক সময় কবিতা নিয়ে মেতেছিলেন এ শহরে, তাদের দুয়ারে-দুয়ারে ঘুরেছি। আশ্বাসের পর আশ্বাস। এই বুঝি হয়ে গেলো আমার সোনার চাকরি। না, বছর ঘুরে যায়। তাদের মিষ্ট সম্ভাষণে কমতি নেই। আমিও ওই সুন্দর আচরণে মোহিত। কিন্তু চাকরি আর হয় না। এই টেনশনে থেকে শেষে বস্তি এলাকায় প্রধানত যৌনকর্মীদের নিয়ে কাজ করে এমন এক ক্লিনিকে চাকরি জুটল ’৭০ দশকের এক কবির আগ্রহে। এ ১৯৯৯ সালের কথা। বছর ঘুরতেই হাতে এল চাকরি থেকে বিচ্যূতির এক সুদর্শননোটিশ। আমি বিমূঢ়। আবার সেই পথের সাথি। এখন বলুন, অনেকের ভিড়ে আমি আদৌ পৃথক? আর আপনার প্রশ্নের শেষাংশ আমাকে স্বভাবদোষের ভাবলোকে নিয়ে গেলো। ভাবছি: হাজার বছরের বাঙলাসাহিত্যে নতুন কিছু কি যোগ করা যায় না? যারা যোগ করেছেন কিছু, তারা কি এই ধূলির সংসারের বাইরের? মানুষের মস্তিষ্কই তো নতুন-নতুনতর পথের সৃষ্টিকর্তা…

প্রত্যালীঢ় : লেখালেখির প্রথম থেকেই আপনি লিটলম্যাগাজিন কর্মকাণ্ডে বেশ সক্রিয়। কী লক্ষে লিটলম্যাগ সম্পাদনা করছেন; এ-আন্দোলনের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গতিপথ আপনার বিবেচনায় কেমন?

হফিজ রশিদ খান : ছোটোবেলা থেকেই লেখালেখি, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে খুব উৎসাহী ছিলাম। ’৭৭-এ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর বড় একটা ছুটি পেয়ে গেলাম। এ-সময়েই স্কুলবন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করি জিগীষা সাংস্কৃতিক সংসদ। এর কর্মকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম ছিলো দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ। আলোকসম্পাত নামের ওই দেয়ালিকা সম্পাদনা করতাম। নিজে লিখতাম, বন্ধুদেরও উৎসাহ যোগাতাম। এভাবে গড়ে ওঠে সাহিত্যচর্চার অনুরাগী একটি দল। এ দেয়ালিকাই পরে মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়। ’৮৫ পর্যন্ত এর ১২ টি সংখ্যা বেরোয়। ইতোমধ্যে আমার ওই বন্ধুদের অনেককেই পড়াশোনা ও পারিবারিক তাগিদে বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে পড়তে হয়। সেলিম আহসান গেল আমেরিকায়, সৈয়দ নূরুল ইসলাম পৈত্রিক ব্যবসায়, শহীদুল আলম- সে ছিল আঁকাআঁকিতে সহজাত মেধার অধিকারী- আলোকসম্পাত’র অলংকরণগুলো সেই করতো- পরে মুদ্রিত আলোকসম্পাত’র প্রচ্ছদশিল্পীও ছিল সে। ও ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গেল। রাশেদ মাহমুদ, শওকত আলী, নাসিমুল হুদা নওশাদ, কাজী আইয়ুব, কামরুজ্জামান, প্রদীপ কুমার নাথ, হাবিবুল্লাহ বাহার- এ-সময়ে আমার খুব ভালো বন্ধু। ওই ’৮০’র দশকের মধ্যপর্বেই কাজী আইয়ুব আর আমি একটু কেমন জানি আলাদা হয়ে শুধু কবিতাচর্চায় মনোনিবেশী হয়ে উঠি। ফলে অন্য বন্ধুদের সঙ্গে অজান্তেই দুরত্ব তৈরি হয়ে যায়। এ-সময়ে দুজনে মিলে প্রকাশ করি রেনেসাঁস। এ-কাগজ খুব কষ্টে প্রকাশ করতাম আমরা। আইয়ুব আর আমি টিউশানি শুরু করি প্রকাশনা খরচ মেটাতে। আন্দরকিল্লা থেকে চকবাজার পর্যন্ত সিরাজদৌল্লা রোডের এমন কোনো মুদ্রণ-প্রতিষ্ঠান ছিল না তখন, যেখানে আমরা লিটলম্যাগ ছাপানোর জন্য ধরণা দিই নি। রেনেসাঁস ছেপে বাইন্ডিং করতাম আমাদের পারিবারিক প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রি ‘আচ্ছাদন’-এ। পিন-গাম লাগাতাম ওখানেই। এমনকি কাগজও চুরি করেছি সরকারি চাকরি থেকে অবসর পাওয়া বাবার ওই ছোট্ট প্রতিষ্ঠান থেকে। রেনেসাঁস-এ বেশিরভাগ কবিতাই থাকতো আমার আর আইয়ুবের। মাঝে-মাঝে নগরের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট আমাদের তির্যক সমালোচনাও মুদ্রিত হতো। ওই সময়েই আমার সঙ্গ গড়ে ওঠে সেবানিকেতন ক্লাবের কয়েকজন কিঞ্চিৎ অগ্রজ সমাজকর্মীর সঙ্গে। শফিকুর রহমান, মোহাম্মদ বখতিয়ার, মনসুরুল আলম, মোহাম্মদ ইউনুস, মাহফুজুর রহমান চৌধুরী কঞ্চন, মোহাম্মদ সিরাজুদৌলা, এজাজ ইউসূফী। এ-ক্লাবের ছিল সামাজিক কর্মকান্ডের বেশ সুনাম। আবার এর একটি সাময়িক সাহিত্যপত্র ধানের শীষে গান ছিল বেশ পরিচিত। বন্ধুদের প্রণোদনায় আমিও জুটে গেলাম ওই ক্লাবের ছত্রছায়ায়। এভাবে ধানের শীষে গান সম্পাদনার দায়িত্ব এসে পড়লো আমার ওপর। মহীবুল আজীজ, এজাজ ইউসূফী, মোহাম্মদ বখতিয়র (শ. ম. বখতিয়ার), লুলুল বাহার, তুতুল বাহার, কাজী আইয়ুব, আবু মুসা চৌধুরী, আসাদ মান্নান, রাহগীর মাহমুদ-সহ অনেকেই তখন এ-কাগজে লিখতেন। ক্লাবটির সক্রিয় সদস্য থাকা কালেই জাগলো নাটকের প্রতি আগ্রহ। শুরু হল সেবানিকেতন থিয়েটারের যাত্রা। এখনকার সাংসদ নুরুল ইসলাম (বিএসসি) ছিলেন সভাপতি, দলপতি আমি। এ-সময় নাটক লেখা হল- হারামনি রেস্তোরাঁ, তস্কর রাজার লস্করগণ, এবার তোমার পালা, কেপ্টেন সাত্তারের গল্প নিয়ে কেদির সাহেবের বৈঠকখানা, একুশের বলয়ে স্বাধীনতা। আমার নির্দেশনায় কয়েকটির মঞ্চায়নও হয় শিল্পকলা একাডেমি, মুসলিম হল আর সে সময়ে সদ্য উদ্বোধন হওয়া আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো চট্টগ্রামের মিলনায়তনে। নাটকগুলোতে এজাজ ইউসূফী, শফিকুর রহমান, মোহাম্মদ বখতিয়ার, নাসিমুল হুদা নওশাদ, সৈয়দ নুরুল ইসলাম, মীর মোহাম্মদ শাহ সুফিয়ান, লুলুল বাহার, মোহাম্মদ হাসেম আর বাদুরতলা-কাতালগঞ্জের অনেক তরুণ অভিনয়ে অংশ নেয়। এসবের সমান্তরালে সাজিদুল হক, হাবিব আহসান, শফিকুর রহমান, সোহেল রাববি, রাশেদ মাহমুদ, মোহাম্মদ সেলিম উল্লাহ, কাঞ্চন বড়–য়ার প্রণোদনায় বেরুলো চারণ। তিনটি সংখ্যা বেরোয়। খুব সুলভ যে মতদ্বৈধতা, দ্রুত ওটার উপস্থিতিতে আমি আর সেলিম উল্লাহ আলাদাভাবে প্রকাশ করলাম বৃষ্টি। প্রচ্ছদ করলেন শিল্পী মাহমুদুর রহমান। একটি সংখ্যাই শুধু বেরিয়েছিল এটির। এ-কাগজগুলোতে কত কবিতা-যে ছেপেছি হিসেব নেই। রাগী, অপ্রথাগত গদ্যও লিখেছি পাশাপাশি। ইতোমধ্যে লেখালেখিতে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ধারণাগুলোও ভালো লাগতে শুরু করেছে। গোগ্রাসে পড়েছি কলকাতার বিজ্ঞাপনপর্ব, জিজ্ঞাসা, কৌরব, অমৃতলোক, বিভাব, গান্ডীব, সেবত্মী

তথ্যপ্রযুক্তির বিপুল-বিশাল বিষ্ফোরণ ঘটে গেছে ইতোমধ্যে। মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ওয়েবভিত্তিক কর্মকাণ্ড বেশ বেগবান। তরুণদের অধিকাংশই ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশী! সেখানেও চলছে নানা ওঝগ, তরিকা, পথ-ভিন্নপথের নানা ওজর, জংগম কোলাহল। আবার লিটলম্যাগের সংখ্যাও বাড়ছে দিন-দিন। গুণেমানেরঙের বৈচিত্রে। পাতলা গড়নের সুদর্শনচক্র, একলব্য, মধ্য‎াহ্ণ, ঢেউ, শঙ্খবাস, অব্যয়, যোগসূত্র, স্বর, চর্যাপদ, ঘুড়ি, নির্মাণ, প্রসঙ্গ, নক্ষত্র যেমন পাচ্ছি তেমনি ঢাউস সাইজের লিরিক, শালুক, নিসর্গ, কবিতাপত্র, সুনৃত, চরাচর কিংবা খেয়াও পাচ্ছি। বিষয়ের বৈচিত্র্য বেড়েছে, বেড়েছে নতুন-নতুন মেধাবী মুখের ঝলকানো সৌন্দর্য-আনন্দ। মুদ্রণশিল্পের নান্দনিক উপস্থাপনার পাশাপাশি দ্রুত তথ্য আদান-প্রদানের প্রযুক্তিগত এই দ্বৈরথে ইচ্ছেমত শুয়ে-বসে পাতা ওল্টানোর, দীর্ঘক্ষণ সুশৃঙ্খল চিন্তা সঞ্চালনের গেরিলা হাতিয়ার লিটলম্যাগাজিনগুলো ভবিষ্যতে তাদের চেতনার ট্রয় বা কুরুক্ষেত্র চালিয়ে যাবেই। আবার বিভন্ন অঞ্চলে বইমেলাকেন্দ্রিক পাঠক-লেখক প্রকাশকদের মেলবন্ধন আয়োজনও পিছিয়ে নেই। এসব বইমেলার মাধ্যমে লিটলম্যাগচর্চার পরিধিও বেড়ে যাচ্ছে। এ-ধারা প্রতিহত হবে বলে মনে হয় না।

প্রত্যালীঢ় : পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সাহিত্যচর্চার ওপর আপনার পর্যবেক্ষণ বা অভিমত বিস্তারিত জানাবেন কি?

হাফিজ রশিদ খান : এ-অঞ্চলের ত্রিপুরা ও তন্‌চংগ্যা সমাজের মধ্যে সেকালের রাজা-রাজন্যের সুখ-দুঃখের কাহিনি, ঐতিহ্যগত ধর্মচর্চা, কথ্য-ইতিহাস এসব নিয়ে লেখালেখির পরম্পরা আছে। বিশেষ করে চল্লিশের দশকে বাঙলা ও ইংরেজি ভাষায় চাকমা ও ত্রিপুরারা বেশ বইপত্তর লিখেছেন। চুনিলাল দেওয়ানের চাকমা কবিতা’র হদিশ পাচ্ছি বেশ ’৪৫ সালে। ’৭০-দশকে রাঙামাটিতে মুরোল্যা সাহিত্যগোষ্ঠি আর জুমিয়া ভাষা প্রচার দপ্তর নামক সংগঠন সুগত চাকমা ও অন্যান্য, জুম ঈসথেটিক্স কাউন্সিল নিয়ে সুহৃদ চাকমা, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমা, শিশির চাকমা, মৃত্তিকা চাকমা সহ অনেকে কবিতা-নাটক-সাংস্কৃতিক সাংগঠনিকতায় এ-ধারাকে ব্যাপ্ত-বিস্তৃত করেছেন। এ-সময়ে লেখা হয়, দীপংকর শ্রীজ্ঞান চাকমার কাব্য অন্তর্গত বৃষ্টিপাত, পাদারঙ কোচপানা (সবুজাভ ভালোবাসা)। ’৮০-দশকে বাংলাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের যে স্ফূরণ, তার ঢেউ আদিবাসী সংবেদনশীল মানুষের মনেও লাগে। নতুন চেতনার স্পর্শে এখানে জাগে নতুন সাহিত্যচর্চার অনুপ্রেরণা। মাতৃভাষার পাশাপাশি বাঙলায়ও নানা পত্রপত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে সজীব-সপ্রাণ হয়ে ওঠে আদিবাসী সাহিত্যের প্রাঙ্গণ। এ-সময় প্রকাশিত হয় কবি অরুণ রায়ের কাব্য ঝরাপাতা (১৯৮৫), সুহৃদ চাকমার বার্গী (১৯৮৭)। এছাড়া জুম ঈসথেটিক্সের বিজু বা চৈত্রসংক্রান্তির প্রকাশনাগুলোতো বেশ আন্তরিক ও সমৃদ্ধ। পাশাপাশি অপ্রাতিষ্ঠানিক চাকমা তরুণ-তরুণীদের রঁদেভু হল চাদিগাঙ, রানজুনি, মাওরুম, রেঙ, তন্‌চংগ্যা তরুণদের পহর জাঙাল, তৈন্‌গাং, মারমা ছাত্রদের চেদ্‌না, তৈচিংগ্লি ইত্যাদি সাহিত্যপত্র ও লিটলম্যাগাজিনে পার্বত্য সংস্কৃতির বেশ ঋদ্ধ উপস্থিতি পাচ্ছি। মারমা তরুণ মং সিং ঞোর অন্তঃসত্ত্বা কার্পাসমহল (২০০৪) সম্ভবত মারমাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত বাংলা ভাষায় প্রকাশিত একমাত্র কাব্য। আবার ম্রো চাক খুমি জনগোষ্ঠির তরুণ-তরুণিরাও পিছিয়ে নেই। নিজেদের উদ্যোগে প্রকাশিত সাময়িক পত্রিকা ও ছোট কাগজে সৃজনকর্মের প্রতি তাদের পপাত স্পষ্টভাবে মুদ্রিত হচ্ছে।

আমার মনে হয়, সমৃদ্ধ বাঙলা সাহিত্যের পাশে ওরা যে নিজেদের মাতৃভাষায় সাহিত্যচর্চা বা আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখির জোরদার প্রয়াস চালাচ্ছে। এটা ইতিবাচক। হয়তো বাঙলা ভাষাভাষি বৃহত্তর পাঠকের কাছে চাকমা, মারমা, তন্‌চংগ্যা, খুমি, ম্রো ভাষা একেবারেই অপরিচিত- তারপরও ওদের নিজস্ব ভাষায় লিখতে-পড়তে চাওয়াটাকে আমি আত্মসম্মানবোধের জাগরণ বলেই শনাক্ত করি। অনেকের মনে হতে পারে বাঙালি পাঠক ওই ভাষা সমূহের কাছে কিভাবে যাবে? আমি বলবো, যারা ওই ভাষা-সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে ওদের জানতে-বুঝতে চায় তাদের জন্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনুকূল ব্যবস্থা রাখা দরকার। অর্থাৎ আদিবাসী ভাষা-সাহিত্য শিক্ষালয় থাকা দরকার। এসব না থাকায় আগ্রহী সাহিত্যব্রতীরা যেন অন্ধকার গলির ভেতর আদিবাসী সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে ঝাপসা-ঝাপসা আলাপে দিনযাপন করছে। এ-থেকে নিষ্কৃতি চাইলে মুক্ত মনোভাব নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক আদিবাসীচর্চার ধারা সৃষ্টি করতে হবে।

প্রত্যালীঢ় : আগের জনমে আপনি আদিবাসী ছিলেন, এ-জনমে বাঙালি। বোধ হয় এ-জন্যে আমরা আপনার সম্পাদিত সমুজ্জ্বল সুবাতাস-এ পার্বত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির মেলবন্ধন লক্ষ করছি। মেলবন্ধনের এ-কাজটা করতে গিয়ে কখনো বাঙালি ও আদিবাসীদের রোষানলে পড়েছেন কী?

হাফিজ রশিদ খান : আমি তো আদিবাসীই, অর্থাৎ আদিম অধিবাসী। এ-জনপদে, এ-পৃথিবীর, যা আদি, যা অকৃত্রিম-তার সঙ্গে আমার স্নায়ু ও রক্তবেগের সম্পর্ক। আমি তো প্রথম যুগে গাছের ফলমূল, পাতা, পোকামাকড় সংগ্রহ করে জীবনধারণ করতাম। গাছের গুঁড়ির ফাটলে, গুহায় ঘুমাতাম। পরে মাছ শিকার করতে শিখলাম, পশু-পাখি শিকারে অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম। ওই সময়ে আমি সশস্ত্র ছিলাম- আমার অস্ত্র ছিলো গাছের শুকনো ডাল-পালা ও পাথর। আরও পরে পশুপালন ও পশুচারণের সংস্কৃতি রপ্ত করি। তারপর কৃষিকার্য উদ্ভাবন। তবে গরু-ঘোড়া বা লাঙলে নয়, চাষাবাদ করতাম লাঠি দিয়ে মাটিতে গর্ত করে বীজ বা চারা রুয়ে দিয়ে। যা এখনও আদিবাসী সমাজে প্রচলিত। যাকে ওরা জুমচাষ বলে। এ-আদিমতা আমি ভুলি কীভাবে? তবে হ্যাঁ, আমি যখন শিখে গেলাম বেঁচেবর্তে থাকার আর্ট বা কলানৈপুণ্য, তখন ঘোষণা দিয়ে হলাম জাতি, রচনা করলাম জাতিরাষ্ট্র। ওই যে চর্যাপদ’র কবি জানিয়ে দিলেন : ‘ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলা’! আমি সেই আদিম, আমি সেই বাঙালি। আর সেই জন্যই তো বাংলার আদিবাসীদের আমি সবসময় বুক দিই, পিঠ দিই না। ইতিহাস আর নৃতত্ত্ব এ-বোধ আমার ভেতরে চারিয়ে দিয়েছে, কী আছে আমার করার?

সমুজ্জ্বল সুবাতাস-এর কথা বলছেন, এ বড় আনন্দের কথা নয়, এ বড় সুখের কথা নয়। বহু গালমন্দ, বহু তিরস্কার, বহুনিন্দা-মন্দ এ-গণ্ডার চামড়ায় সয়ে-বয়ে তবেই এ-কাগজের পথচলা। ’৯০ সালে পার্বত্য বান্দরবান তখন এখনকার সময়ের চেয়ে অনেক পশ্চাৎপদ। আলো-আঁধারির এক মফস্বল এলাকা। প্রায় ধনুর্ভঙ্গ পণ নিয়ে আমিনুল হক মাস্টার, চৌধুরী বাবুল বড়ুয়া, কাশেম আদনান, শফিকুর রহমান সহ এ-কাগজ শুরু করি। প্রথম থেকেই আমার লক্ষ ছিল এতে আদিবাসী জীবন ও সে সংস্কৃতির মৌল বিষয়গুলো তুলে আনা। সে কাজ এখন অনেকটাই স্পষ্টতা পেয়েছে। বহু আদিবাসী তরুণ-তরুণী এর পাতায় লিখতে পেরে গর্ববোধ করে। আমার ভাল লাগে। গত ফেব্রুয়ারি ২০১১-এ এর ১৯তম সংখ্যা বেরুল। আদিবাসীময় সূচি আর ভাবনায় এ এখনও সমৃদ্ধ। চলবে এর অগ্রযাত্রা। হ্যাঁ, আমার জীবনে এও ঘটেছে, চুরি করেছি যার লাগি, সে-ই প্রকাশ্যে ডেকেছে চোর। সেই সঙ্গে অবমাননা। সমুজ্জ্বল-এর ৮তম সংখ্যায় (ফেব্রুয়ারি ২০০১) লিখলাম “রঙিন ফিতের পরবাস” নামে কবিতা:

“নিনিপ্রু এখন ভারতেশ্বরী হোমসে-
মহান রণদাপ্রসাদ সাহার কীর্তির চাঁদোয়া তলে।

জুমের সতেজ লংকার মতোন আদিবাসী এই তরুণীর
টিচার ছিলেন মিস্ট্রেস নু উ চিং
বাঙালি কবিকে হৃদয়ের মিথে বন্দি
করেছেন বলে
যার ঝটিকা বদনাম রটে
পাহাড়ি উপত্যকার জনপদে-জনপদে।

এই ঘটনাগুলোর ভাঁজে
গুটিশুটি ভ্রুণের আকারে ছিল
ধলপ্রহরের শান্তশ্রী মাখানো একজন
                        ফেরিঅলা :

তির্যক রোদের দুপুরে যে ফেরি করেছিল
              বেলোয়ারি চুড়ির নিক্কণ আর
রঙিনফিতের রকমারি পরবাস !”

কবিতার একটি নষ্ট ও যৌনগন্ধি ব্যাখ্যা হাজির করে ওদের একটা অংশ সংবাদ সম্মেলন করল, মিছিল-বিক্ষোভ করে আমাকে ঘোষণা করল অবাঞ্ছিত। সমুজ্জ্বল’র কপি জড়ো করে বহ্ন্যুসব করে লংকাকাণ্ড বাধিয়ে দিল। বান্দরবান জেলা প্রশাসককে স্মারকলিপি দিয়ে আমার শাস্তি চাইল। পাশাপাশি পেলাম প্রকৃত সজ্জন ও সমঝদার মানুষের সাহচর্য, সমর্থন ও সহায়তা। এদের মধ্যে বাঙালি ও আদিবাসী উভয়েই ছিল। এ এক অদ্ভুত সঞ্চয় বটে।

প্রত্যালীঢ় : বাংলাদেশে দর্শনভিত্তিক সাহিত্য আন্দোলন- যেমন : উত্তর আধুনিক, উত্তর-আধুনিক কিংবা উত্তরাধুনিকতা বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কি? এসব আন্দোলন তাদের অভীষ্টে পৌঁছাতে পেরেছি কি?

হাফিজ রশিদ খান : প্রারম্ভিক ইতিহাসে কোন ম্যানিফেস্টোভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সাহিত্যচর্চার প্রয়োজন হয় না। সেই চর্যাপদ’র কালে সিদ্ধাচার্যগণ দেশ জাতি-মানুষ, সর্বোপরি, অস্তিত্বের প্রয়োজনে এবং মন্ময় চেতনার আলোকে ধর্মসূক্তগুলো রচনা করেছেন। সেগুলোই দুর্দান্ত মনীষা এবং জীবনের টানে কাব্য হয়ে, গান হয়ে উঠে। ভাবুন শাক্ত, বৈষ্ণব, সুফি, নাথ ইত্যাদি পদাবলির অন্তর্গত আবেদনের কথা। আরও পরে ব্রিটিশ উপনিবেশিকতার ভেতর ঈশ্বর গুপ্ত, বিহারীলালরা কী করলেন- মননের বিস্তারে সমাজচেতনার পক্ষে কবিদের সৃষ্টিসম্ভারকে ব্যাখ্যা করলেন। সে জন্যে ঈশ্বর গুপ্ত প্রতিভাত হলেন ‘যুগ-সন্ধিণের কবি’ আর বিহারীলাল ‘ভোরের পাখি’ রূপে। বস্তুত তারা তো স্বতোপ্রণোদিত জীবন ও সুন্দরের পক্ষে আকুতি নিয়ে সৃজনশীলতার বন্দনা করেছেন। আরও পরে মাইকেল-রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলেও দেখি প্রধানত তারই সম্প্রসারণ। মাইকেল প্রচন্ড শক্তিমন্ত কবি-নাট্যকার, দুর্দান্ত জীবন-অভিসারীও। এ শিল্পী আবার প্রবলভাবে পাশ্চাত্য সাহিত্যপ্রেমী। উপনিবেশিকতার সূত্রেই তিনি ওই বিশাল নান্দনিক ভুবনে ভিড়লেন। এ তার পলায়ন নয়, এ তার ক্ষুধিত চেতনার দুর্বার অভিযাত্রা। ফলাফল এই যে, তিনি পাল্টে দিলেন অভ্যস্ত চিন্তাচেতনার ভোলচাল। অথচ দেশকে পরিপ্রেক্ষিতকে হেলা করলেন না মোটেই। রবীন্দ্রনাথও সেই একই পন্থি। আবহমানকালের ভারতীয়তাকে নিয়ে পাশ্চাত্য সাহিত্যের সনিষ্ঠ পাঠে তার সৃষ্ট সাহিত্যের সদরমহল। চিন্তা ও চেতনার নানা স্ববিরোধিতা সত্ত্বেও তাকে তো পাই মাটি-মানুষ আর জীবনের আরাধনায় নিমজ্জিত এক জাগর সত্তারূপেই। নজরুলে দেখি এক পরিচ্ছন্ন উপনিবেশবিরোধী শিল্পীর সুস্পষ্ট অবয়ব। সাযুজ্যপূর্ণভাবে তিনি সৃষ্টিমুখর। অর্থাৎ নান্দনিকতার প্রশ্নে নজরুল তাবৎ দ্রোহ ও না-মানার মধ্যেও এক শৃঙ্খলিত দেবতা। এ ধারার প্রথম ব্যতিক্রম তিরিশের পাঁচ পাণ্ডব। ভারতীয়তা, স্বদেশকে পরিপ্রেক্ষিতকে গৌণভাবে রেখে তারা অভিপ্রয়াণ করলেন পাশ্চাত্য তথা ইউরোজ্ঞান ও নান্দনিক রাজ্যের নানামহলে। পাশ্চাত্য আধুনিক কবিতার বাঙলা সংষ্করণ নির্মাণে তারাই তো প্রথম ম্যানিফেস্টো জাতীয় নিয়ম-কানুনের একটা বাতাবরণ তৈরি করলেন। অর্থ্যাৎ অসীমকে সীমায় বন্দি করার প্রয়াস। কারণ ততদিনে বড় বোধ, বড় প্রেম, বড় বেদনার যথেষ্ট চাষাবাদ হয়ে গেছে পূর্বপুরুষদের সৃষ্টিসম্ভারে। এও নিশ্চয় বড় মনীষার কাজ। এ ধারারই নানা রূপ, আঙ্গিক ও বহিঃপ্রকাশ এ কালের দর্শনভিত্তক আন্দোলনগুলো। আসলে তো এক অর্থে জীবনটা দর্শন দিয়েই শুরু। পৃথিবীটা দর্শনেই ঘেরা। কিন্তু সাহিত্য তো শুধু দর্শন নয়। বিশ্ববোধের সমস্ত কিছুকে ধারণে সম এক শক্তিশালী সৌন্দর্যতাত্বিক মাধ্যম এটি। দর্শন তার ছিটেফোঁটা অংশ মাত্র। আর কবিতা সে তো সর্বভূক। এক ভয়াবহ দাবানল। পুরাণে-জীবনে এ আগুনের আঁচের কথা আছে। শরীর পোড়ায় না এ। জনপদের ঘরে ঘরে এর কোনো দাগ থাকে না। কিন্তু চৈতন্যে লাগে। ফলে জীবন যায় বদলে। আপনারা যে দর্শনকেন্দ্রিক সাহিত্যআন্দোলনের কথা বললেন- সেগুলো চেতনার অগ্নিকাণ্ডের কথা বলে, আমারও ভালো লাগে। কিন্তু ওই আন্দোলনে নান্দনিক কারুকার্য চাই। হ্যাঁ, অস্তিত্বের এ ধরনের জ্বলন্ত প্রহার দেখি ওইসব ম্যানিফেস্টোতে। লিরিক যে উত্তর আধুনিকতার কথা বলে, তার মধ্যে, ওই যে বললাম জীবনের একটা সার্বিক উন্মোচনের আকাঙ্খা আছে। লোকায়ত জীবন, প্রাচ্যের পুরাণ, ধর্মাচার, নিম্নবর্গ, নারী, চলমানতার টুকরো ছবিগুলোর সমন্বয়ে একটি সুন্দর মালা গাঁথার প্রয়াস যেনো পাই এই ভাবান্দোলনে। পাশাপাশি সৃজন-সংরাগে তাদের উদ্যম ও উৎখনন পর্যাপ্ত নয় বলেই আমার ধারণা। অন্যদিকে উত্তর ও আধুনিক-এর মাঝখানে হাইফেনযুক্ত যে ধারণা, তাকে আমি লিরিক-এর অনুকারী বলেই মনে করি। লিরিক যেখানে ভারতীয় পুরাণ লোকাচারের উদ্ভাসনকে সাহিত্যে পরিসর দিতে চায়, এরা সেখানে ইসলামি জীবনধারার প্রতিচ্ছবি আঁকতে আগ্রহী, এই যা। এই প্রণোদনাও বাক-বিতণ্ডা আর পাল্টাপাল্টি গদ্যরচনার কানাগলিতে লুকিয়ে গেছে। আর উত্তরাধুনিকতা এদেশীয় মার্কসবাদে অনুরাগী পণ্ডিত-সংগঠকদের সামনে সক্রিয় থাকার একটা লাগসই হাতিয়াররূপে চর্চিত হচ্ছে। নতুনকালের ভাবান্দোলনকে আত্মসাৎ করার এ ধারা বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক প্রয়াসে পর্যবসিত। আবার এসব আন্দোলনের রসদ এসেছে পাশ্চাত্যের সমকালিন দর্শন, সাহিত্য, স্থাপত্য চারুকলা তথা সার্বিক আলোড়ন-বিলোড়ন থেকে। ওই যে পোস্টমর্ডানিজম তারই নানা ভাঙচুর ও মিক্সচার দেখতে পাই আমি এসবের মধ্যে।

প্রত্যালীঢ় : আপনি বিভিন্নভাবে উত্তর-উপনিবেশিক চেতনার পক্ষে বলেছেন। এবং ফ্রাঞ্জ ফানোর মতোন বলেছেন, উপনিবেশিকতার পর বাঙালির মনস্তত্ত্বে নয়া-উপনিবেশিকতা স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু আফ্রিকা মহাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কেউ-কেউ উত্তর-নয়াউপনিবেশিকতার (Post-neocoloniality) কথা বললেও আপনারা কেউ বলছেন না।

হাফিজ রশিদ খান : হ্যাঁ, আমার যা কিছু সামান্য লেখালেখি, তার পশ্চাদভূমি হচ্ছে উত্তর-উপনিবেশিক চেতনা। কেননা ইংরেজি Post শব্দটি সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী ধ্যান-ধারণা, দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক। যার বিগলিত অর্থ হচ্ছে খুঁটি, যা ইতোমধ্যে পোঁতা হয়ে গেছে। যেখান থেকে মতাকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়। যেমন: পোস্ট অফিস বা পোস্টাল ব্যবস্থা। যার আরও সম্প্রসারিত মানে হচ্ছে খুঁটি পুঁতে ফেলার পরবর্তী কাজকর্ম। ঠিক এখান থেকেই পোস্ট বা উত্তর শব্দটিকে কেন্দ্রে রেখে পর্যবেক্ষণ শুরু। অর্থাৎ যা অবধারিত বা পরিবর্তন বা পরিবর্তন সাপেক্ষ নয়, এমন বিশ্বাস জন্মে গেছে বহুদিন আগে থেকে, তাকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করা। প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করতে হয়, আজকের বাংলাদেশ সহ সমগ্র ভারত উপমহাদেশ ১৭৫৭ থেকে বিশ শতকের ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অধীনে একটি উপনিবেশিক কালখণ্ডে সময় অতিবাহিত করেছে। অতএব ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা-উত্তর ভারত প্রবেশ করেছে উত্তর-উপনিবেশিক বা পোস্ট কালোনিয়াল সমাজে। কিন্তু আজকের বাংলাদেশ বা তৎকালের পূর্ব পাকিস্তান সময়ধারার এই অনিবার্যতা থেকে পিছিয়ে পড়ে। পাকিস্তানি শাসকদের অধীনে এ-ভূখণ্ড তখন জড়িয়ে পড়ে নব্য উপনিবেশবাদী শাসন-শোষণের জালে। যা থেকে এ-ভূখণ্ড ও তার জনমানুষের মুক্তি ঘটে ১৯৭১ সালে- রক্তক্ষয়ী মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ী হবার পর। অতএব, বলা যায়, বাংলাদেশে উত্তর-উপনিবেশিক সময়টা চেতন কি অচেতনে এখন পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিকতা তার মজ্জাগত স্বভাবের কারণেই ভূমিজ জীবনের সর্বত্র জবর দখল কায়েম করে, পরম্পরাগত চিন্তাশৃঙ্গলা ভেঙে দেয়, অতীতকে মুছে ফেলে সে জায়গায় শাসককর্তৃক নির্ধারিত ইতিহাসের বীজ বপন করে। পাশাপাশি তার বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও নিত্যনতুন পণ্যসামগ্রীর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন করে বাজার ব্যবস্থাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। এভাবে বহির্জাগতিক সামগ্রিক আধিপত্য সম্পন্ন করার সমান্তরালে মনোজগতে গড়ে তোলে উপনিবেশিক প্রভু ও তার রূপরসমুগ্ধ এক বিপুল স্তাবকশ্রেণি। যারা রক্তে ও বর্ণে ভূমিজ হয়েও আচার-আচরণে বেগানা, লোকায়ত সমাজবিন্যাস থেকে আলাদা, দূরবর্তী। এখন, এ উত্তর-উপনিবেশিক চেতনা ও কালপর্ব বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক প্রত্যয়গুলো থেকে উপনিবেশের যাবতীয় কালিমা ও কলঙ্কচিহ্নগুলো মুছে ফেলার ডাক নিয়ে এসেছে। যে উত্তর-উপনিবেশিক চেতনার কথা বলছি, সে চেতনার ধারক বা বিশ্লেষক না হলে আফ্রিকার দেশে-দেশে যে নয়া-উত্তর-উপনিবেশিকতার বিস্তার ঘটছে, তাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা যাবে বলে মনে হয় না। এ-ধারণা ওই নব্য, আগ্রাসী অথচ বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যকামী প্রবণতাকে গোড়াতেই সনাক্ত করতে সক্ষম। যে দেশ-কালখণ্ডে ও যে আর্থব্যবস্থার ভেতরে আমাদের বসবাস, সেখানে এখন বিশ্বায়নের আপাত মধুর, বায়বীয় অথচ সংহারক উপস্থিতি আমাদের স্নায়ুকে উত্তেজিতই রাখে সর্বক্ষণ, তারই আরেক মূর্তি ও ভাবমূর্তি ওই নয়া-উত্তর-উপনিবেশবাদ। যা সরাসরি নয়, অপ্রত্যক্ষ অথচ জোরালোভাবেই কোনো জাতির ধমনিকে নিস্তেজ ও নিষ্ক্রিয় করে দিতে সক্ষম। বিশ্বের বহু ভূ-খণ্ডই, নিঃসন্দেহে এ-নব্য নেকড়ের মুখে আফ্রোদিতির মতই অসহায় ও রক্তাপ্লুত। যার গোঙানি আছে, চিৎকার নেই। রক্তক্ষরণ আছে, চিকিৎসা নেই।

প্রত্যালীঢ় : সাহিত্য ও দর্শনের জায়গায় একবিংশ শতাব্দির প্রথম দশক থেকে পাওয়া দৃষ্টান্তবাদী বক্তব্যের প্রতি আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই। আপনি একজন উত্তর-উপনিবেশবাদী, আপনার মতাদর্শের সাথে দৃষ্টান্তবাদের কোন সাংঘর্ষিকতা লক্ষ করছেন?

হাফিজ রশিদ খান : দৃষ্টান্তবাদী সাহিত্য ও দর্শনজাত বক্তব্যের সঙ্গে পরিচয়ের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এ-বক্তব্য আমার মনের অনেক অবরুদ্ধ জানালা খুলে দিয়ে আলোময় পরিপ্রেক্ষিত রচনা করেছে। ফলে একধরণের নিঃসঙ্গতা ও জুগুপ্সার কালিমা থেকে আশাবাদী চৈতন্যের প্রান্তরে দাঁড়াবার সাহস পাচ্ছি যেন। যৎসামান্য পঠন-পাঠনে অনুরাগ বা আকর্ষণ থাকলেও দর্শনের মতো বিরাট সাগরে আমার অবগাহন তেমন নেই। সেদিক থেকে দর্শনগত জটিল সূত্র ও ব্যাখ্যার দিকে পা বাড়াতে আমার কুন্ঠা থাকলেও এ-বক্তব্যের সাহিত্যতাত্ত্বিক স্বচ্ছ ও সুবেদী আলোচনা আমাকে এক নতুন আশার সচ্ছলতা দিয়েছে। এ-চৈতন্যের প্রবক্তা কবি সবুজ তাপস ও প্রধান বিশ্লেষক মহীন রীয়াদ-এর কয়েকটা টান টান গদ্যে একেবারে তারুণ্য-ভরপুর জীবনের গান শুনেছি আমি। বিশেষ করে তারা চলমান বাংলাদেশের সাহিত্যবন্ধ্যাত্ব ও কবি-কবিতাকেন্দ্রিক অন্ধ ও অনুভূতিহীন নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে নবতর মুক্তি-সংগ্রামের সূচনা করেছেন। আমি আশ্বস্ত হয়েছি যে, এ-বক্তব্যের তরুণরা নির্বোধ, আত্মমুগ্ধ ও ছদ্মবেশী সাংস্কৃতিক পরিবেশের ভ্রষ্টামি উচিত মাত্রায় অনুধাবন ও তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন বলে। ইন্টারনেটেও এ-আন্দোলনের জাল ছড়িয়ে পড়েছে। তরুণ-তরুণতর ছাড়াও প্রকৃত সাহিত্য ও সংস্কৃতিপ্রেমীরাও এদিকে ঝুঁকে পড়ছে। গদ্যের সম্মার্জনী হাতে, চেতনার উল্লাসে দৃষ্টান্তবাদী সাহিত্য ও দর্শনের এ-গতিবেগ প্রবলতর হবে- প্রত্যাশা রাখি।

না, উত্তর-উপনিবেশবাদী চৈতন্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিকতা তো নয়ই, বরং আমি উভয়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমিক সাযুজ্য বা ঐক্যই দেখেছি। উত্তর-উপনিবেশবাদ যেখানে দাসত্ব ও তথাকথিত আবরণ-আচ্ছাদনের বেনিয়া সৌকর্য ত্যাগ করে মনের ও প্রত্ন-ঐতিহ্যের সময়-উপযোগী চর্চা ও উদ্ভাসন দাবি করে, সেখানে দৃষ্টান্তবাদ সহযোগী মনীষা ও নন্দনের অবতার হয়ে আলো ছড়াতে পারে। উভয় দৃষ্টিভঙ্গির সমঝোতা স্মারক এখানেই স্বারিত হতে পারে।

প্রত্যালীঢ় : ’৭০ থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত চেরাগী পাহাড়কে ঘিরে বিভিন্ন গ্রুপওআরি আড্ডা গড়ে উঠেছে। আপনি কোন্ আড্ডাকে সাহিত্যের জন্য নিবেদিত অথবা সাহিত্যে নতুন কিছু যোগ করেছে বলে মনে করেন?

হাফিজ রশিদ খান : ওই আড্ডাগুলো নিয়ে আমার কোনো ইতিনেতির মনোভাব নেই। কারণ, আমি প্রায়শ লক্ষ করি, আড্ডা মানেই সৃজনশীলতা, নন্দনচর্চা, মানবিকতা, সৌন্দর্য নির্মাণ ও সম্ভোগ- এমন হবে কথা নেই। নানা কৌণিক বৈষয়িক দৃষ্টিকোণ থেকেও নানাবিধ আড্ডা গড়ে ওঠে। আর বাঙালীর আড্ডাপ্রীতি সে তো বহুবিদিত। হ্যাঁ, সাহিত্যের জন্য আড্ডা বা সংস্কৃতিমনস্ক আড্ডা সে বড় দুর্লভ। পরচর্চা-পরনিন্দা-পরশ্রীকাতরতা এ-অঞ্চলের আড্ডাগুলোর প্রধানতম তিলকরেখা হয়ে আছে। হ্যাঁ, কিছু বিবেকী-সংবেদী নতুনত্বের অভিসারী- জীবনে সমাজে সাহিত্যে – এমন মানুষের আড্ডা যে একেবারেই নেই বা ছিল না তা বলব কেন। তবে তারা দিন-দিন অণুবীক্ষণিক হয়ে উঠছেন। জেল্লাদার জীবনের হাতছানি, পণ্য ও বিলাসের মাধ্যমে পরের মুখ ম্লান করে দিয়ে গজদন্ত মিনারের অধিবাসী হতে চাওয়া বিশ্বায়নের এ-করাল গ্রাস সুকুমার আড্ডার অবয়ব ভেঙে দিচ্ছে খুব নির্দয়ভাবে। মনে হচ্ছে দিন-দিন, যা বিগত হচ্ছে, তার ভেতরেই যেন ভালোটা, সুন্দরটা, কল্যাণের অংশটা বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

আশির দশক চট্টগ্রামের সবুজ আড্ডা
আশির দশকের প্রথম দিকে চট্টগ্রামের সবুজ আড্ডায় (বামদিক থেকে (দৃশ্যমান) হাফিজ রশিদ খান, মাঝখানে সাজিদুল হক, নাট্যজন মশিউর রহমান আদনান। ডানদিকের দেয়ালের পাশে মোহাম্মদ বখতিয়ার, পাশে এজাজ ইউসুফী।

সেদিক থেকে মনে হয়, বিগত ৮-৯ দশকে চট্টগ্রামের সবুজ আড্ডাই সততার, নিবেদনের আর কমিটমেন্টের একটা স্থান দখল করতে পেরেছে। এ-আড্ডারুদের মধ্যে ক্রোধ ও তারুণ্যজাত সীমাবদ্ধতা হয়তো চোখে পড়তে পারে কারো-কারো, কিন্তু সাহিত্যপ্রীতি, সংস্কৃতিমনস্কতায় কোনো খাদ ছিল না এতে। চিন্তনের সদর্থকতাকে তারা দুর্বার গতি ও আনন্দে ফলপ্রসূ করতে কসুর করেছে, এমন কেউ বলতে পারবে- মনে হয় না আমার। এ-আড্ডাই উত্তর আধুনিক সাহিত্যভাবনার প্রসার ঘটিয়েছে, বাংলা কথাসাহিত্যের প্রকৃত পরশুরাম আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মূল্যায়ন করেছে, নিম্নবর্গীয়-অবহেলিত এদেশের আদিবাসী জীবন ও সংস্কৃতিকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। শুধু কথার তুবড়িতে নয়, দলাদলিতে নয়, বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াকু দৃষ্টিভঙ্গি ও মুদ্রিত নান্দনিক উপস্থাপনায়। আমি যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে বলছি, সবুজ আড্ডারুরা বাংলা সাহিত্যে অবশ্যই নতুন কিছু যোগ করেছে। কালের নির্মোহ ও নিরপেক্ষ বিচার, আমার বিশ্বাস এ-অবদানকে পাশ কাটাবে না।


পূর্ব প্রকাশ: চেরাগীআড্ডা, ২০১৩

Loading

Scroll to Top