African Penguins (Spheniscus demersus) Bernard Dupont

বোল্ডার্সে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের মুখোমুখি

শুধুমাত্র অ্যান্টার্কটিকায় নয়, পেঙ্গুইনদের সঙে দেখা হবে পৃথিবীর উষ্ণ মহাদেশ আফ্রিকায়! আর বোল্ডার্সে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের মুখোমুখি অভিজ্ঞতার জন্য সরনাপন্ন হতে হবে দক্ষিণ আল্টান্টিকের ঠান্ডা জলের। গ্রানাইট পাথরের কারণেই সৈকতটির নাম বোল্ডার্স বা পাথুরে সৈকত; যা অনেকের কাছে বোল্ডার্স উপসাগর হিসেবে পরিচিত।

বর্তমানে এই আফ্রিকান পেঙ্গুইন প্রজাতি সংকটাপন্ন হওয়ায় টেবিল পর্বত জাতীয় উদ্যানের অংশ হিসেবে উত্তরে সিগন্যাল হিল থেকে দক্ষিণে কেপ টাউন পর্যন্ত বিস্তৃত এই বোল্ডার্স অঞ্চলটিকে পেঙ্গুইনদের জন্যে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। কেপ টাউন শহরের ২৭টি পেঙ্গুইন উপনিবেশের মধ্যে বোল্ডার্স অন্যতম।

মূলত আফ্রিকান পেঙ্গুইনদের উপনিবেশের কারণে এটি পৃথিবীর জনপ্রিয় সৈকতগুলোর মধ্যে অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ। দক্ষিণ আফ্রিকার উপকূলীয় অঞ্চলেই এই আফ্রিকান পেঙ্গুইনদের দেখা যায়, যদিও আফ্রিকা মহাদেশের নামিবিয়ায়ও এদের ক্ষুদ্রাংশের বসতি রয়েছে। অথচ এই পেঙ্গুইনরাই বর্তমানে বিলুপ্তির প্রান্তে। এর মূলে রয়েছে অতিরিক্ত মাছ ধরা, বাসযোগ্য স্থান ধ্বংস, পানি ও পরিবেশ দূষণ, এবং উপকূলীয় অঞ্চলে বেআইনী পর্যটন কার্যক্রম। ২০১০ সালের ২৬ মে এই প্রজাতিকে বিপন্ন বা সংকটাপন্ন ঘোষণা করা হয়।

পেঙ্গুইনদের উপনিবেশ তৈরির পূর্বে বোল্ডার্সে অবাধে ঘুরে বেড়াতো পেঙ্গুইনের দল। তাদের এতোটাই অবাধ বিচরণ ছিলো যে প্রায়ই গাড়ির চাকায় পিষে মরতো অনেক পেঙ্গুইন। ফলস্বরূপ, কেপ প্রকৃতি সংরক্ষণ কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে টেবিল পর্বত জাতীয় উদ্যান প্রকল্পের আওতায় পেঙ্গুইনদের সুরক্ষায় আনা হয়েছে। আবাসিক এলাকার মাঝখানে এই উপকূলে এদের রাখা হলেও হাতেগোনা কয়েকটি স্থানের মধ্যে বোল্ডার্স একমাত্র স্থান যেখান থেকে পৃথিবীর ১৭ প্রজাতীর মধ্যে এই বিপন্ন স্ফেনিস্কাস ডিমেসাস (Spheniscus demersus) প্রজাতীর পেঙ্গুইনদের সুরক্ষিত প্রাকৃতিক পরিবেশে অবাধে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। বোল্ডার্সেই রয়েছে এতোটা ঘনিষ্ঠ পরিসরে এই কালো স্যুটপরা পেঙ্গুইনদের পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ!

১৯৮২-১৯৮৩ সালের দিকে মাত্র দু’টি প্রজনন জোড়া থেকে, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এই উপনিবেশে প্রায় ৩,০০০ পাখি রয়েছে। ২০১১ সালের হিসেবে এখানে মোট পেঙ্গুইনের সংখ্যা ছিলো প্রায় ২,১০০, যেখানে ২০০৫ সালে ছিলো ৩,৯০০ পেঙ্গুইন। আফ্রিকান পেঙ্গুইনরা সারা বছর ধরে বংশবৃদ্ধি করলেও তাদের প্রধান প্রজনন ঋতু শুরু হয় বছরের ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ শীতের দিকে। একটি স্ত্রী পেঙ্গুইন একসঙ্গে দু’টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে সক্ষম, ফলে অন্যান্য পেঙ্গুইনের তুলনায় এদের দ্রুত বংশবিস্তার ঘটে।

বোল্ডার্সে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের মুখোমুখি
ব্ল্যাক ফুটেড পেঙ্গুইন। ছবি: লেখক।

মেরু অঞ্চলের দীর্ঘকায় পেঙ্গুইন, যাদেরকে টেলিভিশনে দেখতে আমরা অভ্যস্ত তাদের সঙ্গে আফ্রিকান পেঙ্গুইনদের তেমন মিল নেই। প্রজাতী নাম স্ফেনিস্কাস ডিমেসাস হলেও ছোটখাটো চেহারার এই পেঙ্গুইনরা ব্ল্যাক ফুটেড পেঙ্গুইন নামে পরিচিত। অর্থাৎ পায়ের পাতা কালো হবার কারণে এধরনের নাম। এদের পূর্ণবয়স্ক পেঙ্গুইনগুলির উচ্চতা ৬০ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার আর ওজন দুই থেকে সাড়ে তিন কেজি পর্যন্ত হতে পারে। গড় আয়ু ১৮ থেকে ২০ বছর হলেও ব্ল্যাক ফুটেড পেঙ্গুইনদের ২৭ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকর ইতিহাস রয়েছে।

বোল্ডার্সে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের মুখোমুখি
সমুদ্রেরের তলে পেঙ্গুইনের সাঁতারচালনা। ছবি: হালাস্টন।

পেঙ্গুইনদের প্রধানতম খাদ্যের মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক মাছ যেমন ফিলচার্ড বা সার্ডিন এবং অ্যাঞ্চোভি জাতীয় ক্ষুদ্র পোনামাছ, তবে তাদের পছন্দের তালিকায় স্কুইডও রয়েছে। এই পেঙ্গুইনরা ঘন্টায় গড়ে সাত কিলোমিটার গতিতে সাঁতার কাটতে পারে এবং দু মিনিটের বেশি সময় ধরে জলে ডুবে থাকতে অভ্যস্ত।

সমুদ্রে এদের প্রধানতম শত্রু হাঙ্গর আর বাদামী পশম সিল এবং মাঝেমাঝে শিকারি তিমি। যদিও তাদের স্বাতন্ত্র কালো আর সাদা রঙ সমুদ্রের জল আর সূর্যের আলোয় ক্যামোফ্লাজ বা ছদ্মবেশের কাজে আসে যা শিকারীদের থেকে তাদের কিছুটা হলেও রক্ষা করে।

ডাঙায়ও তাদের শত্রুর অভাব নেই, নেউল, জেনেট (বিড়ালসাদৃশ প্রাণী), গার্হস্থ্য বিড়াল এবং কুকুর এদের উদ্রেগের কারণ। তবে তাদের সবচেয়ে ক্ষতিকর শত্রু হলো কেল্প গল নামের উপকূলীয় পাখি, যেগুলো পেঙ্গুইনদের তা দেয়া ডিম ছানা ফুটবার আগেই চুরি করে নেয়।

আফ্রিকার উষ্ণতায় বেঁচে থাকার জন্যে খুদে পেঙ্গুইনেরা তাদের শারীরবৃত্তীয় কৌশলের উন্নয়ন ঘটিয়েছে তাদের চোখের উপরের গোলাপি রঙের আস্তরণের সাহার্যে, যার নাম পিংক গ্ল্যান্ড। এই গ্ল্যান্ড বাইরের তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। দেহের তাপমাত্রা বাড়লে পিংক গ্ল্যান্ড তাদের শরীরে অতিরিক্ত রক্ত সঞ্চালন করতে থাকে। সামুদ্রিক হাওয়ার সংস্পর্শের কারণে এই রক্ত থাকে কিছুটা শীতল, যার কারণে দেহের তাপমাত্রাও কমতে শুরু করে।

বোল্ডার্সে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের মুখোমুখি
সতর্কবার্তার পরও অনেকেই পেঙ্গুইনদের ধরে দেখতে চায়। ছবি: লেখক।

আচরণে এই পেঙ্গুইনেরা ঠান্ডা স্বভাবের হলেও সংকট আসন্ন অনুভব করলে উড়তে না পারা পাখিগুলো তাদের সুতীক্ষ্ণ ঠোঁট দিয়ে কামড়ে দিতে পারে। নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য এরা অনেকটা গাধার মতোন শব্দ করে তথ্য আদানপ্রদান করে। তাই এদের আঞ্চলিক নাম জ্যাক-অ্যাস।

বোল্ডার্সে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের মুখোমুখি
কাঠনির্মিত বোর্ডওয়াক। ছবি: লেখক।
বোল্ডার্সে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের মুখোমুখি
বছরে গড়ে ৬০,০০০ পর্যটক বোর্ল্ডাসে আসেন আফ্রিকান পেঙ্গুইনের মুখোমুখি হতে। ছবি: লেখক।

কয়েক বছর আগে বোল্ডার্সে তিনটি হুইলচেয়ার-বান্ধব বোর্ডওয়াক নির্মাণ করা হয়, ফলে প্রতিবছর ঘুরতে আসা প্রায় ৬০,০০০ পর্যটকদের এখানে হেঁটে বেড়ানোসহ পেঙ্গুইনের ছবি আর পেঙ্গুইনের সঙে সেলফি নেয়ার কাজটি আগের তুলনায় সহজতর হয়েছে। যদিও ছবি নেয়ার উত্তম সময় ভোরে যখন পেঙ্গুইনরা সমুদ্রে অভিগমনে বের হয় আর সূর্যাস্তে যখন তারা ফিরে আসে। বোর্ডওয়াকগুলো পেঙ্গুইনদের চলাচলের পথে বালিয়াড়ি বাতাস সঞ্চালনে সাহায্য করে, এছাড়াও উদ্ভিদ জন্মানোর জন্যে তৈরি করেছে অনুকূল পরিবেশ। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশে পেঙ্গুইনদের বাসস্থান এবং তাদের ছানাদের রক্ষাও করে এই কাঠনির্মিত বোর্ডওয়াকগুলো।

একদিকে আদিবাসী গুল্মের সীমানা, এবং অন্যদিকে ফল্স উপসাগরের পরিষ্কার জল ঘেসা এই অঞ্চলে কয়েকটি ছোটো আশ্রয়স্থল রয়েছে, যা আংশিকভাবে ৫৪০ মিলিয়ন বছর বয়সী গ্রানাইট পাথরে বেষ্টিত। জলের তীব্র স্রোত, উচ্চ তরঙ্গ, ঝড়ো হাওয়া থেকে উপসাগরটিকে রক্ষা করছে বোল্ডার বা পাথরের বড় চাঁইগুলি, যা পেঙ্গুইন ছানাদের জন্যেও অঞ্চলটিকে নিরাপদ করে তুলেছে। এখানকার অগভীর জল ও সৈকতের সাদা বালি মা-বাবা-ছানা পেঙ্গুইনদের সাঁতারের জন্যেও আদর্শ।

কীভাবে ঘুরবেন: বোল্ডার্স সৈকত যেমন পেঙ্গুইনদের জন্য চমকপ্রদ স্থান, তেমনি জনপ্রিয় পরিবার-বান্ধব সাঁতারের সৈকত। এখানে শিশুরাও পাথরের চাঁই আর শিলা পুলগুলিতে ইচ্ছেমতোন ঘুরে বেড়াতে পারে, সাঁতার কাটতে পারে পেঙ্গুইনদের কাছাকাছি ফল্স উপসাগরীয় পরিষ্কার ঠান্ডা জলে।

অবকাশ যাপনের জন্যেও বোল্ডার্স আকর্ষণীয় সৈকত। ৭৫ দক্ষিণ আফ্রিকান র‌্যান্ডের (বাংলাদেশী টাকায় ৪৪৫-৪৫৫) বিনিময়ে এখানে আগে থেকেই স্থান সংরক্ষণ করা যায়। তবে সীমিত পার্কিং ব্যবস্থা থাকায় গ্রীষ্মের মরশুমে এখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাওয়াটাই শ্রেয়। পার্কিং স্থানের কাছেই রয়েছে মিনি গল্ফ কোর্সে গল্ফ খেলার ব্যবস্থা। উন্মুক্ত সৈকতে মদ্যপান-ধূমপানের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও রয়েছে মাউন্টেন বাইকিং, ওয়েলিং এবং বাঞ্জি জাম্পিং-এর সুযোগ।

কখন যাবেন: মূলত বিপন্ন প্রজাতির পেঙ্গুইনদের জন্য প্রসিদ্ধ হওয়ায় বোল্ডার্স সৈকতে ভ্রমণের উপযুক্ত হলো পেঙ্গুইনদের বসতির সময়- অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি থেকে আগস্ট। এছাড়াও সাঁতারের উপযোগী সময় হলো অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি।

দর্শনার্থীদের জন্য বোল্ডার্স সারা বছরই উন্মুক্ত রাখা হয়। তবে পরিবেশ ও আবহাওয়ার কারণে প্রতিদিনের দর্শনের সময়সীমা বছরে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারি সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭:৩০টা পর্যন্ত, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০টা পর্যন্ত, মে থেকে সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৫টা পর্যন্ত এবং অক্টোবর থেকে নভেম্বর সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৬:৩০টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য বোল্ডার্স উন্মুক্ত থাকে।

কীভাবে যাবেন: বোল্ডার্স সৈকত, দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিম কেপ প্রদেশের কেপ টাউন শহরের কাছাকাছি কেপ পয়েন্ট সৈকত ও ফিশ হোয়েকের মাঝপথে সিমন্সটাউনের কাছাকাছি কেপ পেনিনসুলার ফল্স উপসাগরে অবস্থিত। সিমোন্সটাউন থেকে যার দূরত্ব প্রায় ১.৫ কিলোমিটার। নিকটবর্তী কেপ টাউন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এম.৩ (M3) রুটে প্রায় ৫৩.৪ কিলোমিটারের পথ। কেপ টাউন থেকে গাড়ি অথবা ট্যাক্সিযোগেও এখানে আসা যায়। এছাড়াও কেপ টাউন থেকে সিমোন্সটাউন পর্যন্ত রেলওয়ে পরিসেবাও রয়েছে।

টিকিটের মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৭৬ র‌্যান্ড (বাংলাদেশি টাকায় ৪৪০-৪৫০, ২০১৮ সাল অনুযায়ী) ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের (২-১১ বছর) জন্য ৪১ র‌্যান্ড (বাংলাদেশি টাকায় ২৩০-২৪০, ২০১৮ সাল অনুযায়ী)। ওয়াইল্ড কার্ডধারীদের জন্য রয়েছে এক বছর মেয়াদী বিনামূল্যে প্রবেশের সুযোগ।


ইবোলা সম্পর্কে সতর্কতা: অনেকেরই আফ্রিকা ভ্রমণের পূর্বে ইবোলা সংক্রমণ নিয়ে উদ্বেগ হতে পারে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার কর্তৃক ইবোলা-সংক্রমিত পশ্চিম আফ্রিকান দেশগুলি থেকে আগত ভ্রমণার্থীদের প্রবে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকেরা নিজের দেশে ফেরৎ আসার সময় তাদেরকেও মেডিক্যাল স্ক্রিনিং-এ সফলভাবে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই দেশে পুনঃপ্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।

প্রচ্ছদ ছবি: বার্নার্ড ডুপোন্ট/ফ্লিকার


পূর্বে প্রকাশিত: জার্নি প্রচ্ছদ | বাংলা ট্রিবিউন | ২৬ অক্টোবর ২০১৮


আরো পড়ৃন: নেলসন ম্যান্ডেলার রোবেন দ্বীপ

Loading

Scroll to Top