Album back - Back from the Brink (2011)

ইরানের রক আইকন কুরুশ

তুরস্কের আনাতোলিয় রকের গোড়াপত্তনে যেমন বরিস মানচো (১৯৪৩–১৯৯৯) কিংবা এরকিন কোরাইয়ের (জন্ম ১৯৪১) কথা স্মরণে আসে, তেমনি ইরানে সাইকেডেলিক রক বা নেটিভ রক আন্দোলনের প্রসঙ্গে কুরুশ ইয়াঘমইকে টানতে হয়। বিটলসের সঙ্গীতে সেতার পরিবেশনের মধ্য দিয়ে পূর্বপশ্চিম বা ইস্টওয়েস্ট নামক সঙ্গীতের যে নতুন শৈলীর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, বিভিন্ন দেশে তার ভিন্নতা রয়েছে। আনাতোলিয় রক বা আল্লা তুরকা আন্ডারগ্রাউন্ডের মাধ্যমে তুরস্কের সঙ্গীত যেভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, ইরানও একইভাবে তার নিজস্ব উপায়ে প্রভাবিত হয়েছে। তাল চেতনায় ব্রিটিশ আগ্রাসন এই জাতীয় অঞ্চলের প্রতিটি দেশে জাতীয় প্রতিচ্ছবির প্রেরণায় একটি খাঁটি আকারে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে। এই অভিজ্ঞতার বাস্তব ধারণার নিশ্চিত উদাহরণ ইরানের রক আইকন কুরুশ ইয়াঘমই।

ইরানে রক সঙ্গীতের একজন প্রতিষ্ঠাতা-স্থপতি হিশেবে ইয়াঘমইয়ের নাম এখনও চিহ্নিত রয়েছে, যদিও ইসলামি শাসন ব্যবস্থার নামে ইরানের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র থেকে তার সমস্ত প্রভাব মুছে ফেলার প্রচুর চেষ্টা চলেছিল। তার লম্বাচুল, গিটারের সুরের কারিশমা এবং অশ্বক্ষুরাকৃতির গোঁফ যা তুরস্কের বরিস মানচো কিংবা সার্জেণ্ট পেপার যুগের জন লেননের স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি এমনকি একাদশ শতাব্দীর ফার্সি কবিদের কবিতায় সাইকেডেলিক সঙ্গীতের সমন্বয়ে ইরানের অতীত ও আধুনিক যুগের নিখুঁত সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। ইরানে ১৯৭৯-এর অন্ধকার ইসলামি বিপ্লব না ঘটলে, নিশ্চিতভাবেই তার একটি ধারাবাহিক এবং আরও ফলপ্রসূ সাঙ্গীতিক কর্মজীবন গড়ে উঠতো। তবে বিপ্লব পরবর্তী সময়ে অনেকের মতোন প্রবাসে নির্বাসিত হওয়ার ধারণা প্রত্যাখ্যান করে বরং তিনি সঙ্গীতে প্রতিরোধশক্তিকে অন্তরঙ্গ করে তুলেছিলেন।

ইয়াঘমইয়ের জন্ম ৩ ডিসেম্বর ১৯৪৬ সালে, তেহরানের পূর্বে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে ইরানের সেমানান প্রদেশের শাহ্রুড শহরের মধ্য জেলার এক সচ্ছল পরিবারে। তার কুরুশ নাম, পারস্য সম্রাট মহান কুরুশ (আনু. ৬০০ – ৫৩০ খ্রিপূ) থেকে উদ্ভূত। তার পিতামহ ছিলেন একজন ভূস্বামী এবং দূরবর্তী পূর্বপুরুষদের একজন ছিলেন ইরানের কবি। পরবর্তীতে তিনি তেহরানে স্থানান্তরিত হন এবং সেখানে শহিদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। দশ বছর বয়সে বাবার কিনে দেওয়া প্রাচ্যের বাদ্যযন্ত্র সন্তুর শেখার মধ্য দিয়ে সঙ্গীতে তার হাতেখড়ি হয়। পরবর্তীতে তিনি তার ১৫ বছর বয়সে গিটার বাজানো শুরু করেন এবং পশ্চিমা সঙ্গীতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

তিনি প্রথমে দ্য র‌্যাপচার্স নামে একটি ব্যান্ড গঠন করেন, যেটি ছিল ১৯৫৮ সালে গঠিত বিখ্যাত আমেরিকান সার্ফ-রকার দ্য ভেনচার্সের অনুপ্রেরণা। শহিদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান পড়ার সময় তারা সার্ফ-রক বাজাতে শুরু করেছিল। ১৯৬৭ সালে দলটির সদস্যদের (লাইনআপ) মধ্যে ছিলেন, ইয়াঘমই (কণ্ঠ, গিটার), বাহরাম সাদি (ইলাকট্রিক গিটার), কামরান খাশেহ (অর্গান), জাহাঙ্গির (বেস) এবং ভিগুয়েন (ড্রাম)। সে সময় তারা দ্য ভেনচার্স, দ্য কিংস, দ্য বিটল্‌স এবং দ্য মানকিজের কভার করতো।

অন্যদিকে, সে সময়ে তেহরানে কোনও বাদ্যযন্ত্রের দোকান না থাকায় দলটি হতাশাগ্রস্ত ছিল। এমনকি তাদের কাছে যথাযথ বেস না থাকায়, ১৯৬৫ সালে তারা গোল্ডেন মাইক্রোফোন প্রতিযোগিতায় পরিবেশনের সময়, তুরস্কের সেলুক আলাগাজের (জন্ম ১৯৬৭) মতোন তাদের বেস প্লেয়ার জাহাঙ্গির ইলাকট্রিক গিটারের শুধুমাত্র ৫ম ও ৬ষ্ঠ রিফ্‌স বাজিয়েছিল।

র‌্যাপচার্সের যুগে ইরানের ব্যান্ডগুলি সাধারণত অন্য ব্যান্ডের গান কভার করতো যা মূল সঙ্গীতের অংশ হিশেবে নিজস্ব সঙ্গীত তৈরি করতে অনেকটাই ব্যর্থ ছিল। অন্যদিকে, গোল্ডেন রিংস এবং ওজেবেহ ছিল ব্যতিক্রমী, কারণ তারা মূল ইরানি সুরের চর্চার পাশাপাশি ইরানের চিরাচরিত সঙ্গীত দ্বারা প্রভাবিত রচনাগুলি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। ততোদিনে ফার্সি রক এবং পপ ব্যান্ডগুলি তাদের মূল সঙ্গীত পরিবেশন করতে হাজির হয়। ব্ল্যাক ক্যাট, রেবেল্‌স (ইয়াঘমই কিছুকাল এই দলে বাজিয়েছিল) ধীরে-ধীরে ফার্সি রক চেতানায় তাদের স্থান করে নেয়।

১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে, ইয়াঘমই তার ভাইদের সহায়তায় নিজস্ব ব্যান্ড গঠন করেন। দলে তিনি গিটার বাজাতেন ও গান গাইতেন এবং তার ভাই কামরান ইলাকট্রিক গিটার বা কখনও কখনও ড্রাম বাজাতেন। ব্যান্ডের অন্য সদস্যদের মধ্যে রদবদল ঘটতো। চাঙ্গিজ ফরজাদ সাধারণত ড্রামবাদক ছিলেন, তবে ব্যান্ডের শুরুর দিকে ড্রাম বাজাতেন ফারোক হেজাজি। যদিও সর্বশেষ লাইনআপে কিবোর্ডবাদক ছিলেন ইয়াঘমইয়ের ভাই কাম্বিজ; এছাড়াও হুমান দরিয়াস, ফেরিবার্জ আখগার, মেহরজাদ কয়েকটি গানে কিবোর্ড বাজিয়েছিল। ইয়াঘমই কিছু ট্র্যাকে বেহরুজ সূরির বেস বাজাতেন, বিজন মোজেদি এবং চার্লি বেট দাভুড বিভিন্ন ট্র্যাকের বেসবাদক ছিলেন।

ইরানের রক আইকন কুরুশ

স্টুডিও বেলে প্রথম রেকর্ডের সময় ইয়াঘমইয়ের ব্যান্ড ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সরারসরি রেকর্ড করছিল। ততদিনে তারা স্টুডিও পপ নামে একটি ৮-ট্র্যাক স্টুডিওতে প্রচারণা চালায়। এমনকি গিটার ব্যতীত শুধুমাত্র একক কণ্ঠে ৮-ট্র্যাকের মাধ্যমে তিনি সরাসরি রেকর্ড করেছিলেন। ব্যান্ডের সর্বশেষ স্টুডিও ছিল স্টুডিও সাবা, যেখানে তারা ১৬-ট্র্যাকের মাধ্যমেও রেকর্ড করেছিল।

ব্যান্ডটির নেটিভ প্রগ এবং সাইকেডেলিক রক ইচ হুরাল, বারিস মানচো, এরকিন কোরাাই এবং এমনকি আলপে টাইপের আনাতোলিয় পপ ধারার (যখন তিনি ফেরিট আর্গিন, জাফের ডিলিক এবং মাজদাত আকগানের সাথে রেকর্ড করেছিলেন) ক্মরণ করিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে, একটি আকর্ষণীয় দিক হিশেবে তিনি ঘোষণা করেন যে তিনি সে সময় পশ্চিম, আরবি এবং ভারতীয় সঙ্গীত থেকে রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও তুরস্কের কোনও রেকর্ডের মালিক ছিলেন না।

১৯৭৩ সালে, তেহরানের শহিদ বেহেস্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় ইয়াঘমইয়ের অভিষেক একক গান প্রকাশিত হয়। “গোলে ইয়াখ” (“বরফের ফুল”) গানটি লিখেছিলেন সেসময়ের তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু মেহেদি আখভান ল্যাঙ্গরোদি, যিনি পরবর্তীতে আধুনিক ফার্সি সাহিত্যের অন্যতম কবি হিশেবে বিবেচিত হন। গানটি ইয়াঘমইয়ের সঙ্গীত জীবনের শুরুতেই দুর্দান্ত খ্যাতি এনেছিল এবং যা পরে বিভিন্ন ভাষার সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। “গোলে ইয়াখ” মূলত শোকগাথা।

“..যখন চোখের পাতায় বিদ্বেষ নামে, বৃষ্টি ঝরে
দুঃখের বন্যা আমাকে অভিভূত করে
যখন তুমি পাশে থাকো, একাকীত্ব বয়ে যায় বাতাসে
দুচোখ রাতের বৃষ্টি ঝরে
আমার হাতে স্পন্দিত বসন্ত, তারপর চলে যায়
হৃদয়ে বরফের ফুল ফোটে..”

গোলে ইয়াখ (১৯৭৩)

ইয়াঘমই তার চুক্তিবদ্ধ রেকর্ড সংস্থা অহেঞ্জ রুজ থেকে ৪টি একক প্রকাশ করেন, যেগুলি ১৯৭৫ সাল অবধি প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালে “গোলে ইয়াখ” / “দেল দারেহ পির মিশেহ” (“আমার হৃদয় বুড়ো হয়ে যাচ্ছে”) ও “লায়লা” / “পাইজ” (“শরৎ”), ১৯৭৪ সালে “হাজমে খালি” (“শূন্য স্তূপ”) / “আখম নাকন” (“ভ্রূক্ষেপ কোরো না”) এবং ১৯৭৫ সালে “সারাবে তো” (“তোমার মরীচিকা”) / “দার এন্তেহা” (“সব শেষে”) মুক্তি পায়। রেকর্ডগুলির উচ্চ বিক্রয় সত্ত্বেও তিনি সেই সমস্ত রেকর্ড থেকে কেবলমাত্র স্বল্প রয়্যালটি অর্জন করতে সর্মথ হয়েছিলেন।

১৯৭৫ সালের দিকে ইরানে ক্যাসেট টেপের প্রচলন শুরু হওয়ার পর ভিনাইল সেক্টর হ্রাস পেতে শুরু করে। যে কারণে ইয়াঘমই ২০১১ সাল পর্যন্ত ভিনাইল বিন্যাসে অ্যালবাম প্রকাশ করতে পারে নি। সে বছর নাও-অ্যাগেইন রেকর্ডস থেকে তার ট্রিপল অ্যালবাম ব্যাক ফ্রম দা ব্রিংক: প্রি-রিভল্যুশনারি সাইকেডেলিক রক ফ্রম ইরান: ১৯৭৩–১৯৭৯ প্রকাশ হয়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে, তিনি ইরান টেলিভিশন ইনসেপশন কমিটির সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ক্যাসেটে অ্যালবাম রেকর্ডিংয়ের সাথে জড়িত ছিলেন।

পারস্যের কবিতা ইয়াঘমইয়ের সঙ্গীতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান নিয়েছে। তার বাদ্যশৈলী ইরানি সাইকেডেলিক রক এবং ব্লুস-রক ধারায় অনন্য সঙ্গীত অবদান। ইরানি রক সঙ্গীতে প্রচুর নতুন উদ্ভাবন নিয়ে এসেছিলেন তিনি, গিটারের সুরে গানের তাল হিশেবে কিবোর্ডের ব্যবহার এই উদ্ভাবনের অংশ। তার সঙ্গীতের বিষাদগ্রস্ত চিত্র বর্ণনা, ব্লুজ রিফ্‌স, স্ট্রিংস এবং অ্যানালগ সিনথেসাইজার শব্দগুলি হৃদয়কে স্থির করে তোলার অনুভূতি তৈরি করে। নরম স্ট্রাইক এবং কঠিন খাদশব্দময় ড্রাম তার সঙ্গীতে স্বাক্ষর রেখেছে। প্রায় ৬-৮ মিনিট দীর্ঘ গানগুলি, সহজেই অনেক প্রগ্রেসিভ আন্দোলন সঙ্গীতের অংশ হতে পারে। ইরানি লেখক ইব্রাহিম নববির মতে, “ইরানি সাইকিডেলিক রক ধারায় ইয়াঘমইয়ের গভীর প্রভাব রয়েছে।” অন্যদিকে ব্রিটিশ-ইরানি সুরকার আশঙ্কান কুশানেজাদের মতে, “গ্রহণযোগ্য উপায়ে পশ্চিমা-প্রাচ্য হাইব্রিড সঙ্গীতে অবদানকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম।”

১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে ইয়াঘমই ২৪টি গানের রেকর্ড করেছেন। এর মধ্যে ১৭টি গান হাজমে খালি (১৯৭৫) এবং সারাব-ই তো (১৯৭৭) অ্যালবামে ক্যাসেট সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছিল। বাকি ৭টি গান ১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে বিপ্লব-পূর্ব দাঙ্গাকালীন সময়ে রেকর্ড করা হয়েছিল। যদিও এই ৭টি গান একটি অ্যালবামের উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছিল; যার মাস্টার কপি বেতার কনসার্টে ব্যবহৃত হবার পরে হারিয়ে যায়। হারানো মাস্টার টেপের পরিবর্তে একটি “রিল টু রিল” টেপ, যেটি বেতার সম্প্রচারে ব্যবহৃত মাস্টার থেকে রেকর্ড করা হয়েছিল।

১৯৭৯ সালে ইয়াঘমই এবং ফেরেদুন ফৌরহি দুটি গান রেকর্ড করেন

বিপ্লবের পরে, ইয়াঘমই অনুভব করেছিলেন যে অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিমা সঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং তিনি সল-ই ১, সল-ই ২, এবং সল-ই ৩ নামে তিনটি অ্যালবাম রেকর্ড করেছিলেন। প্রথম সল-ই ১ (লাইভ এফেক্টের সাথে রেকর্ডকৃত) ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত হয় এবং সল-ই ২ (ফেরেদুন ফৌরহির সাথে রেকর্ডকৃত) ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হলেও আনুষ্ঠানিক বিতরণের জন্য বিক্রি করা যায় নি, তবে তার পরিবর্তে সরাসরি বিক্রয় হয়েছিল। সল-ই ৩ অ্যালবাম প্রকাশকালীন সময়ে ইরানে সঙ্গীতের উপর তৎকালীন শাসকের চাপ পূর্বের তুলনায় আরও অসহনীয় হয়ে ওঠে। এ কারণেই অ্যালবামটি সরকারিভাবে প্রকাশ করা যায় নি। যেটি পরে আরাইশ-ই খোরশিদ নামে ২০০০ সালে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত সল-ই ১ অ্যালবামের গানগুলি নিয়ে ১৯৯৬ সালে লস অ্যাঞ্জেলেস ভিত্তিক ফার্সি সঙ্গীত সংস্থা ক্যালটেক্স রেকর্ডস থেকে পারান্দে মোহজের নামে সিডি সংস্করণে পুনরায় প্রকাশিত হয়।

১৯৮০ সালের নিষেধাজ্ঞার শুরুর মধ্য দিয়ে আইনী সীমা নির্ধারিত হলে পরবর্তীতে তার প্রভাব বিস্তার করেত শুরু করে। নিষিদ্ধ ছিল পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার। রাস্তার বিক্ষোভগুলিতে সেই বাদ্যযন্ত্রগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং সঙ্গীত স্টোরগুলিতে আক্রমণ করা হয়। ১৯৮০ সালে ইরানে টিকে থাকা একমাত্র সঙ্গীত সংস্থা ছিল শাবানেহ। শাবানাহের কার্যালয়েও মৌলবাদীরা অভিযান চালায়। বিপ্লবী মিছিল বাদে সমস্ত সঙ্গীত সম্প্রচার, সে সময় নিষিদ্ধ ছিল। অন্যদিকে, পশ্চিমা বাদ্যযন্ত্রগুলি প্যারাডক্স হিশেবে সহজেই শোনা যেতো। সোনালি দিনের ইরানের কথা মনে করিয়ে দিতে পারে বলে, পাশ্চাত্য সঙ্গীতের পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী প্রেমের গান এবং এমনকি লোকসঙ্গীতও নিষিদ্ধ করা হয়। নারীদের গান করা এমনকি সঙ্গীতে নেপথ্য কণ্ঠদানও নিষিদ্ধ হয়।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক কেভান হ্যারিসের মতে, ইসলামি বিপ্লবের পরে সরকার পশ্চিমা এবং ইউরোপিয় সংস্কৃতির প্রভাব বন্ধ করতে অত্যধিক অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেছিল; ফলে তারা ইয়াঘমইয়ের মতোন সঙ্গীতশিল্পীদের হ্রাস করতে দৃঢ়প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে। এই সময়কালে ইয়াঘমই সচেতন ছিলেন যে বিপ্লবের নতুন নিয়মগুলি কাটিয়ে উঠতে তিনি বিভিন্ন মনোভাব ব্যবহার করতে পারতেন। তিনি তার সঙ্গীত সেন্সরকারী কর্মকর্তাদের ঘুষ দিতে পারতেন, অন্য শিল্পীদের জন্য সঙ্গীত রচনা করতে পারতেন বা তার অন্যান্য সহকর্মীর মতোন দেশ ত্যাগ করতে পারতেন। সে সময়ে অনেকেই ইরান ত্যাগ করে লস অ্যাঞ্জেলেস, মন্ট্রিয়ল, প্যারিস এবং অন্যান্য ইউরোপিয় দেশগুলিতে যেখানে নির্বাসিত সম্প্রদায়ের বসতি স্থাপন করা হয়েছিল সেখানে নির্বাসিত হতে বাধ্য হয়েছিলেন। তার ভাই কাম্বিজ ইউরোপে অভিবাসন পেয়েছিলেন। তার সঙ্গীতশিল্পী পুত্র ২০০৫ সাল নাগাদ কানাডার ভ্যানকুভারে বাস করছেন। যদিও ইয়াঘমই তার আদর্শের দিক বিবেচনায় ইরান ত্যাগ করেন নি। তার মতে:

“আমার বিশ্বাস, যদি আমার কর্মজীবন পরিবর্তন করতাম তবে তা আমার সঙ্গীত এবং নিজের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ হতো এবং এটির অর্থ সাংস্কৃতিক শিকড়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাও বটে। যখন আমার বিগত ৩৭ বছরের দিকে ফিরে তাকাই তখন যা করেছি তা নিয়ে আমি গর্বিত বোধ করি। এই যুদ্ধের অংশে একই শক্তিতে মোটামুটিভাবে না থাকলেও আমি প্রতিরোধ করতে পছন্দ করি।”

ইয়াঘমই, ফ্রম ন্যাশনাল স্টার টু এনিমি অব দ্য স্টেট, ভাইস, মে ২০১৬

ইসলামি বিপ্লবের পরে সতেরো বছর ধরে ইয়াঘমই ইরানে নিষিদ্ধ ছিলেন। এই সময়ে তিনি শিশুদের জন্য বই ও ক্যাসেট প্রকাশ করেন। ১৯৮৭ সালে তিনি দ্বার নামে একটি যন্ত্রসঙ্গীত অ্যালবাম প্রকাশের অনুমতি পান। অ্যালবামটিতে ইয়াঘমইয়ের আয়োজিত মহান জাতীয় অর্কেস্ট্রায় বাজানো লোকসঙ্গীতের ব্যবহার ছিল। তার রেকর্ডিং সেশনের সময়, তাকে ঘোষণা করতে হয়েছিল যে তিনি রেকর্ডিংয়ে বেস, গিটার এবং ড্রাম ব্যবহার করবেন না।

১৯৯১ সালে ক্যালটেক্স রেকর্ডস গোলে ইয়াখ শিরোনামে তার “১৯৭০ সালের সেরা” গানের সংকলন প্রকাশ করে। ১৯৯৩ সালে যখন এই নিষেধাজ্ঞাগুলি আরও শিথিল হয়ে আসে, তখন নরওয়ে এবং সুইডেনে কনসার্টে পরিবেশনের অনুমতি পায় ইয়াঘমই। তখন তিনি চাঙ্গিজ ফারজাদের সাথে কমিশনার হয়ে কাজ করছিলেন, এবং নিজের একটি নতুন ব্যান্ড গঠনের চেষ্টা চালিয়েছিলেন। ইয়াঘমই তাকে মহড়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং ফরজাদ ড্রামের কাঠি হাতে কান্নারত হয়ে বলেন, “আমি আর বাজাতে পারি না”।

ইরানের রক আইকন কুরুশ
ইয়াঘমই নরওয়ের একটি কনসার্টে

যেমন ইয়াঘমই বলেছিলেন “ইরানের সেরা ড্রামবাদক আর কখনও বাজবে না।” এই কনসার্টের জন্য কাভে ইয়াঘমই (কি), আইনুল্লাহ কিভানশোকোহ (ড্রাম), বাবাক রিয়াপৌর (বেস), মোহাম্মদ পিরজাদেহ (পার্কাসন) সহকারে একটি ব্যান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং তারা নরওয়ে ও সুইডেনে একটি সফল সফরে অংশ নিয়েছিল।

১৯৯৪ সালে ইয়াঘমইয়ের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করা হয় এবং শীঘ্রই তিনি একই বছরে সিব-এ নোঘরেই (রূপালি আপেল) নামে একটি অ্যালবাম প্রকাশের অনুমতি পান। সে সময়ে ইরানি শাসনব্যবস্থা প্রচ্ছদশিল্পে শিল্পীর আত্ম-আলোকচিত্র প্রকাশে বাধা দেয়ায় কেবল গ্রাফিক শিল্পের প্রচ্ছদে অ্যালবামটি মুক্তি পায়। ১৯৯৬ সালে মাহ ভা পালং এবং ১৯৯৭ সালে কাবস অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ২০০০ সালে সেন্সর থেকে রক্ষা পেতে একটি ট্র্যাক বাদ দিয়ে সল-ই ৩ অ্যালবাম আরেশ-ই খোরশিদ নতুন শিরোনাম প্রকাশিত হয়। ২০০১ সালে প্রকাশিত তোফাং-ই দাস্তে নোঘরে ছিল ইরানে আইনত প্রকাশিত ইয়াঘমইয়ের সর্বশেষ অ্যালবাম। ১৯৯৬ সালে ইতোমধ্যে সল-ই ১ (১৯৭৯) অ্যালবামে প্রকাশিত গানগুলি নিয়ে ক্যালটেক্স রেকর্ডস থেকে পারান্দে মোহজের শিরোনামে একটি অ্যালবাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পুনরায় প্রকাশিত হয়।

ইরানের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদের নির্দেশে বেতার এবং টেলিভিশন পশ্চিমা সঙ্গীত সম্প্রচারের নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে ইয়াঘমইয়ের নতুন নিষেধাজ্ঞার কাল শুরু হয়।

ব্যাক ফ্রম দা ব্রিঙ্ক: প্রি-রিভল্যুশনারি সাইকেডেলিক রক ফ্রম ইরান: ১৯৭৩-১৯৭৯, নাও-অ্যাগেইন রেকর্ডস, ২০১১

অন্যদিকে ইসলামি বিপ্লবের পূর্বে ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে রেকর্ডকৃত ইয়াঘমইয়ের সর্বাধিক পরিচিত সাইকেডেলিক ও প্রগ্রেসিভ রচনাগুলি ভিনাইল, সিডি এবং স্ট্রিম বিন্যাসে নাও-অ্যাগেইন রেকর্ডস থেকে ব্যাক ফ্রম দা ব্রিঙ্ক: প্রি-রিভল্যুশনারি সাইকেডেলিক রক ফ্রম ইরান: ১৯৭৩-১৯৭৯ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। এই ত্রিপল অ্যালবামে, প্রতিটি ট্র্যাক কভার করা হয় নি যাতে ডিজিটাল আকারে সম্পূর্ণ সত্তর দশকের যুগের গানও শোনা যায়। এইভাবে, ইয়াঘমই- এরকিন কোরাই, বরিস মানচো এবং জেসলাও নিমেনের মতোন সঙ্গীতশিল্পীদের সাথেও যোগ দিলেন যারা তাদের দেশের বাইরে পুনরায় আবিষ্কৃত হয়েছিলেন।

বিদেশে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার সময়, ইরানে প্যারাডক্স হিশেবে নতুন ট্র্যাকগুলির রেকর্ড চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে তার হোম স্টুডিওর পরিস্থিতিতে আঘাত করা হয়েছিল। ২০০৩ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ইয়াঘমই অ্যাকোস্টিক সিস্টেম, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, পেশাদার মাইক্রোফোন, অ্যামপ্লিফায়ার, রোল্যান্ড কিবোর্ড, ইলাকট্রিক গিটার, ৮ ট্র্যাক রেকর্ডার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির ব্যবহার না করার নিষেধাজ্ঞা স্বত্ত্বেও একটি অ্যালবাম রেকর্ড করেছিলেন। যদিও, মালেক জামশিদ শিরোনামের অ্যালবামটি ইরানের সেন্সরশিপ থেকে এড়ানো হয়েছিল। কারণ, এটির মাস্টার কপি যুক্তরাষ্ট্রে নাও-অ্যাগেইন রেকর্ডসে স্থানান্তর করা হয়েছিল এবং সংস্থাটি ২০১৬ সালে সিডি সংস্করণে অ্যালবামটি প্রকাশ করে।

সেনফিল্ড টাইপ স্লাপ বেস এবং মিডি সাউন্ড ধারণ করে আদিম শব্দ প্যালেট নির্বাচন করা সত্ত্বেও অ্যালবামটি মূল্যবান, কারণ সকলেই অবগত যে এ প্রতিকূল অবস্থায় ইয়াঘমইয়ের জড়িত থাকতে হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে, উল্লেখ্য যে তার গোলাপি রঙের হোম স্টুডিওর জানালা তেহরানের রাজপথের মুখোমুখি হওয়ায় তাকে মধ্যরাতের পরে রেকর্ড করতে হয়েছিল এবং তার কাছে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার, পেশাদার মাইক্রোফোন এবং অন্যান্য সামগ্রী ছিল না। ইয়াঘমই তার অবস্থার সংক্ষিপ্তসার হিশেবে বলেন:

“ইরানে, লোকেরা আমাকে আধুনিক সঙ্গীত ও রক ধারার রাজা, অগ্রগামী এবং মাস্টার হিশেবে দেখে। অন্যদিকে, আমি সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার মনোভাবের জন্য সরকারের প্রতিবাদ করতে আমার দেশে আমার প্রকাশনা অপ্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এছাড়াও, আমি এর সেন্সরশিপ এবং তার উপর আমার শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের প্রতিবাদ করেছি। এর অর্থ এই নয় যে আমি সুররচনা ছেড়ে দিয়েছি। আমি এখনও আমার লোকদের জন্য প্রতি কয়েক বছর পর অ্যালবাম করার পরিকল্পনা করি। সমগ্র বিশ্বের কাছে এই বিপর্যয়টি জানাতে এবং যাদের ঘৃণা করি তাদের প্রতি মানুষের সহানুভূতি না বাড়ানোর জন্যও আমি এটি লিখছি।”

ইয়াঘমই
ইরানের রক আইকন কুরুশ

বর্তমানে ইয়াঘমই তেহরানে বিনয়ী জীবন যাপন করছেন। তার সঙ্গীতের প্রতি ক্রমবর্ধমান আগ্রহ সম্পর্কে তিনি খুশি যার কিছুটা কারণ ইরানের বিপ্লব-পূর্ব সময়ের প্রতি মানুষের স্মৃতিবেদনা। ভাগ্যক্রমে, নাও-অ্যাগেইনের মতোন সংস্থাগুলির সহায়তায় তিনি তার বহু কাজ প্রকাশের সুযোগ পেয়েছিলেন এবং রেকর্ড সংগ্রাহক ও সাইকেলেডিক রক খননকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার সঙ্গীত অনলাইনে প্রাপ্তিসাধ্য এবং তার বছরের শীর্ষ ভিডিওগুলি ইউটিউবেও রয়েছে। সবশেষে, ইয়াঘমই শুধুমাত্র তার যোদ্ধা মনোভাবের সাহায্যে ইরানকে উদারকরণের ক্ষেত্রে একজন বিনয়ী নয়, তিনি অত্যন্ত মূল্যবান অবদান রেখেছেন যার অনুধাবনে ইরান ব্যর্থ।

Loading

Scroll to Top