দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন শহরের সিগন্যাল পাহাড়ের ঢালে অসমতল এলাকায় বিস্তৃত কেপ-মালয় সংস্কৃতির ঐতিহাসিক স্থান বো-কাপ স্বাধীনতার রঙ ও প্রতীক ধারণ করে। আফ্রিকান শব্দটির অর্থ ‘অন্তরীপের ওপরে’। একসময় এই স্থান মালয় কোয়ার্টার নামে পরিচিত ছিল। বিভিন্ন রঙের ভবন ও খোয়া পাথরের দৃষ্টিনন্দন রাস্তার জন্য জনবহুল স্থানটি বিখ্যাত। এখানে রয়েছে ২৬০ বছরের নিদর্শন ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। বো-কাপ পুরোটাই স্বাধীনতার রঙ।
কেপটাউন সিটি সেন্টার ও ডি ওয়াটারকান্ট থেকে পাঁচ-দশ মিনিট এবং ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলফ্রেড ওয়াটারফ্রন্ট থেকে কুড়ি মিনিটের হাঁটা দূরত্বে বো-কাপের ওয়াল স্ট্রিট। এখানকার সপ্তদশ শতকের গোলাপি, কমলা, চুন-সবুজ, বেগুনি, ফিরোজা, হলুদ, বাদামি, নীলসহ সারিবদ্ধ রঙিন ভবন যেকোনও আলোকচিত্রীর জন্য অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়া দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থান, ইসলামি তীর্থস্থান, প্রথম মসজিদ, খাদ্যরস ও কারুশিল্পের বাজার এবং সুস্বাদু কেপ-মালয় রন্ধনশৈলী উপভোগের জন্য বো-কাপ অন্যতম দর্শনীয়।
ওলন্দাজ ঔপনিবেশিক আমলে ১৭৬০-এর দশকের শেষের দিকে বো-কাপের ড্রপ ও ওয়াল স্ট্রিটের কাছে জমি কিনেছিলেন ইয়ান দে ভাল নামে একজন ওলন্দাজ। একবছর পর রোজ, খিয়াপিনি ও শর্ট মার্কেট স্ট্রিট পর্যন্ত ভালের ভূ-সম্পত্তি প্রসারিত হয়। মালয় কোয়ার্টার নামে পরিচিতি পাওয়ার আগে এলাকাটি ভালেন ড্রপ (ভালের নামানুসারে) নামে পরিচিত ছিল। স্থানীয়রা এছাড়া স্ল্যামস ব্রুট কিংবা স্কচচেক্লুফ নামেও স্থানটিকে ডাকে।
১৭৬৩ সালে ইয়ান ভাল এখানে একতলা ভাড়া ঘর নির্মাণ করে নিজের তৎকালীন ক্রীতদাসদের কাছে সেসব বরাদ্দ দিতে শুরু করে। ‘কেপ মালয়েশ’ নামে পরিচিত এই ক্রীতদাসদের বেশিরভাগই মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার। বাকিদের আফ্রিকার অন্যান্য অংশ থেকে কাজের উদ্দেশে কেপ টাউনে আনা হয়েছিল। মূলত এজন্যই ‘মালয়’ নামের উৎপত্তি। যদিও বো-কাপে আসা সবাই মালয়েশীয় ও মুসলিম ছিল এমন নয়। তবে একই সময়ে কেপটাউনে ইসলামের প্রবেশ ঘটে। এখানকার ভবনগুলো অধিকাংশই একতলা, যা ১৭৯০ থেকে ১৮২৫ সালের মধ্যে কেপ ওলন্দাজ এবং কেপ জর্জিয়া স্থাপত্যশৈলীর মিশ্রণে নির্মিত। যদিও আঠারো শতকের প্রথম দশকে ব্রিটিশ উপনিবেশের কারণে কিছু ভবনে ব্রিটিশ শৈলী নজরে পড়ে।
বো-কাপের প্রথম তিনটি প্রাচীন ভবনের (বর্তমানে বো-কাপ জাদুঘর) একটি রয়েছে ৭১ ওয়াল স্ট্রিটে, বাকি দুটি বুয়েটেনগ্র্যাচ স্ট্রিট এবং ৪২ লিউউইন স্ট্রিটে অবস্থিত। মূলত ব্যবসায়ী, কারুশিল্পী ও কারিগরদের বিস্তৃতির সুবাদে এগুলো নির্মিত হয়েছিল। ১৭৬০-এর দশকের শেষে লিজ গ্রহণের সময় সব বাড়ির রঙ সাদা হওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। তবে ১৮৩৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসরা ফিরে এসে এখানকার ভূ-সম্পত্তি ক্রয়ের অনুমতি পেলে নিয়মটি শেষ পর্যন্ত বিলুপ্ত হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তি লাভের পর মালিকরা তাদের অবদমিত স্বাধীনতার প্রকাশ হিসেবে রঙের এই প্রতীকী চর্চা শুরু করেছিল, যা ১৮০ বছর ধরে বিদ্যমান। বো-কাপে অনেক পরিবার প্রজন্ম ধরে বসবাস করছে। ২০২০-এর হিসাবে এখানে প্রায় ১০ হাজার লোকের বসতি। ঐতিহ্যগতভাবে এলাকাটি বহুসংস্কৃতির অংশ হলেও এর জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ মুসলিম। ১৮২০ সালের দিকে জাভা ও সিলন থেকে রাজনৈতিকভাবে নির্বাসিত মুসলিমরা এই অঞ্চলে আসতে শুরু করে। বর্তমানে বো-কাপ সম্প্রদায় আফ্রিকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ। দক্ষিণ আফ্রিকার ঐতিহ্য সম্পদ সংস্থার মতে, এখানে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক-১৮৫০ সালের স্থাপত্যের বৃহত্তম সংকলন রয়েছে। এটাই এখন পর্যন্ত টিকে থাকা কেপটাউনের প্রাচীনতম আবাসিক এলাকা।
১৯৪৩ সালে বো-কাপ সংরক্ষণের কাজ শুরু হয়েছিল, তখন বিশিষ্ট নাগরিকদের একটি দলের সহায়তায় ১৫টি ঘর পুনরুদ্ধার করে ঐতিহাসিক স্মৃতিস্মারক কমিশন। ১৯৬৬ সালে এলাকার একটি অংশ জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে মনোনীত হয়েছিল। ১৯৭১ সাল থেকে নগর কাউন্সিল এখানকার ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করে। ২০১৯ সালের মে মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বো-কাপ এলাকার ১৯টি স্থান জাতীয় ঐতিহ্যবাহী ঘোষণা করে।
বো-কাপের অন্যতম আকর্ষণ খোয়া পাথরের রাস্তা। ওলন্দাজ উপনিবেশকালে সপ্তদশ থেকে অষ্টাদশ শতকের দিকে তৎকালীন হল্যান্ড (বর্তমানে নেদারল্যান্ডস) থেকে এসব পাথর আফ্রিকায় আমদানি করা হয়। সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে, খোয়া পাথরগুলো ভারি বর্ষণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে বো-কাপকে সুরক্ষা দেয়। যদিও এটি ওলন্দাজদের নির্মাণ পরিকল্পনার অংশ ছিল না।
বো-কাপের প্রায় সব রাস্তায় ম্যুরাল দেখা যায়। এগুলোতে ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সংমিশ্রণ ফুটে আছে।
প্রচ্ছদের ছবি: স্কাই পিক্সেল
পূর্বে প্রকাশিত: জার্নি প্রচ্ছদ : বো-কাপ পুরোটাই যেন স্বাধীনতার রঙ | ১৯ জুলাই ২০২০ | বাংলা ট্রিবিউন