নয়নতারা ফুল কেন নেই

নয়নতারা ফুল কেন নেই

“আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই” ১৯৯১ সালে শহীদুল জহির রচিত ছোট গল্প। এটি জহিরের দ্বিতীয় গ্রন্থ ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প সংকলনে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয়। জহিরের অন্যনন্য গল্প-উপন্যাসে উত্তরাধুনিক সাহিত্য ভাবনার অন্যতম কৌশল জাদুবাস্তবতা প্রয়োগের পারদর্শিতা লক্ষণীয়।

গল্পের প্রেক্ষাপটে উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক জীবনের অবরুদ্ধতার প্রতীক হিসেবে জাদুবাস্তবতার বিবিধ প্রকৌশল ব্যবহার করে আগারগাঁও নামক সরকারি কলোনিতে বসবাসরত মানুষের বৃত্তান্ত রয়েছে। মূলত বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আবাসনের জন্য সৃষ্ট এই আগারগাঁও কলোনিতে বসবাসরত এসকল মানুষেরা পারস্পরিক সম্পর্কে অনাগ্রহী, কৌতূহলশূন্য, নিস্পৃহ। যেখানে সামাজিক মর্যাদা ও আধিপত্যের মানদণ্ডে বসবাসরত কেরানিদের অবস্থান তলদেশে। এধরনের একজন শীর্ণ ও মধ্যবয়সী কেরানি আবদুস সাত্তার “আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই” গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। গল্পে যার জীবনচর্যার রূপায়ণ উদ্দেশ্যপুষ্ট এবং তাৎপর্যবহ। কর্মস্থান এবং কলোনির পারিপার্শ্বিক প্রতিবেশ, অন্যদিকে সমাজ ও বাস্তবতার পরিমণ্ডলে তাল মিলিয়ে চলতে ব্যর্থ আবদুস সাত্তারকে একাকিত্ব ও নৈঃসঙ্গের আবহে আবিষ্কার করা যায়। একপর্যায়ে যা তাকে সংবেদনাশূন্য মাত্রা দেয়। এক ভূমিকম্পের ঘটনায় আবদুস সাত্তারের মৃত্যুর পরে আগারগাঁও কলোনির সব নয়নতারা গাছ শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে এবং প্রতিবাদে আত্মহত্যা করে। এই ইতিবৃত্ত রূপায়ণে শহীদুল জহির জাদুবাস্তবতার বিবিধ প্রকৌশল ব্যবহার করেছেন।

সংসারের গণ্ডিতে আবদুস সাত্তারের নীরব ও নিষ্ক্রিয় উপস্থিতি দেখা যায়। গল্পের শুরুতে বর্ষার এক অপরাহ্ণে বাড়ি ফিরার পথে আকস্মিকভাবে অসতর্কতাবশত তার পা পিছলে পড়ে যাবার ঘটনায় এর প্রমাণ রয়েছে। তিনি তার স্ত্রী শিরিন বানুকে ‘পইড়া গেলাম কেদোর মইধ্যে’ বলার আগ পর্যন্ত কাওকে বিষয়টি খেয়াল করতে দেখা যায় না। স্ত্রী শিরিন বানু, ছেলে-মেয়ে নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লে সময় অতিবাহিত করার তাড়নায় আবদুস সাত্তার অবলম্বন করে নেয় কলোনির বাসার ছোট বারান্দাকে। একদিকে কেরানি চাকরিতে ক্লান্তি বোধ করতে থাকে আবদুস সাত্তার। অন্যদিকে যন্ত্রনির্ভর সমাজে প্রকৃতিবিমুখতা ঘোচাতে শিরিন বানু কলোনির বাসায় বারান্দায় বিভিন্ন গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ লালন শুরু করে। এতে কলোনিবাসীর পারস্পরিক দূরত্ব কমতে শুরু করলেও আবদুস সাত্তার নিঃসঙ্গ থেকে যায়। তার নিস্পৃহ চেতনালোকে এসব আলোড়িত করেতে পারে না। এরপর কলোনিবাসীদের যৌথ উদ্যোগ ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় কলোনিটি প্রকৃতির বর্ণাঢ্যতায় পরিণত হলে হলুদ রঙের প্রজাপতির আবির্ভাব ঘটতে শুরু করে। লালচে বেগুনি রঙের নয়নতারা ফুলে আচ্ছাদিত এই কলোনির প্রতি প্রজাপতিদের মোহমুগ্ধ আকর্ষণের ঘটনা দ্রুত অনত্র ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদপত্রে সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশের পর উৎসুক মানুষ চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে আবদুস সাত্তারের বাসার সামনে রাস্তায় জমায়েত হয়। তবে কিছুদিনের ব্যবধানেই বৈচিত্র্যসন্ধানী মানুষের কাছে এই ঘটনা একঘেয়েমিপূর্ণ বিবেচিত হওয়ায় তারা প্রজাপতিদের লক্ষ্য করে ঢিল ছুড়তে শুরু করে। অন্যদিকে ভিড় উদ্দেশ্য করে ভ্রাম্যমাণ খাদ্য বিক্রেতারা জড়ো হয়। ফলে অকস্মাৎ সৃষ্ট এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নগরে শান্তি-শৃঙ্খলার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে অস্থায়ী পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের অধীনে প্রজাপতিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদে সংবিধিবদ্ধ সতর্কবাণী জারি করা হয়। এসব নির্দিষ্ট ঘটনায় রয়েছে জাদুবাস্তবতার প্রচ্ছন্ন ব্যবহার। কেননা, অন্য কোন ফুল এবং শুধুমাত্র হলুদ প্রজাপতিদের আগমন আর একমাত্র নয়নতারা ফুলের প্রতি তাদের আকর্ষণ থেকে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়। জাদুবাস্তবতার আরেকটি বৈশিষ্ঠ হল কোন ঘটনার নির্দষ্টকরণ। কেউ যদি বলে হাতি আকাশে উড়ে, এ কথায় অনেকেই কান দেবেন না, কিন্তু যদি বলা হয় ৩৭৫ টি হাতি আকাশে উড়ে, তাহলে এতে অনেকেই কৌতুহলী হবেন। এক বছর অতিক্রান্ত হলেও প্রজাপতির উপস্থিতি আবদুস সাত্তারের স্থবির মনোলোকে আবেদন সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়। বরং প্রজাপতির উপস্থিতিতে বৈচিত্র্যসন্ধানী মানুষের ঢিল নিক্ষেপের ঘটনায় বিরক্ত হয়ে আবদুস সাত্তার বারান্দা পরিত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও নতুন সামরিক সরকারের উদ্যোগে মিরপুর চিড়িয়াখানা আধুনিকায়ন করার ফলে চিত্তবিনোদনের জন্য নগরবাসীরা কলোনির পরিবর্তে সেখানে যেতে শুরু করায় তার এ ভাবনার পরিবর্তন ঘটে। উল্লেখ্য, সামরিক সরকারের উল্লেখ দ্বারা সম্ববত ১৯৮২ সালে জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ কর্তৃক রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের ঈঙ্গিত করে। এ পর্যায়ে শিরিন বানু কর্তৃক তার পরকীয়া প্রণয়ের অভিযোগ উঠলেও আবদুস সাত্তারের গতানুগতিক জীবনের প্রভাববিহীন পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে। কিন্তু জীবনের প্রতি তার সকল মায়া বিলীন হয়ে যায় নি, তা ইতঃপূর্বে বোঝা না গেলেও আকস্মিক ভূমিকম্পের ঘটনায় সে বোধের দ্বারা তাড়িত হয়ে আবদুস সাত্তার বারান্দার রেলিঙে দড়িবাঁধা নয়নতারা গাছের দুটি টব রক্ষার প্রচেষ্টায় মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ভূমিকম্পের ঘটনায় আগারগাঁও কলোনির একমাত্র নিহত ব্যক্তি আবদুস সাত্তারের পাশাপাশি সকল নয়নতারা গাছের উন্মূলিত হওয়ার ঘটনা ঘটে।

এখান থেকেই আমরা বাস্তবতার গণ্ডি অতিক্রম করে জাদুবাস্তবতায় প্রবেশ করি। জীবদ্দশায় নয়নতারার প্রতি আবদুস সাত্তারের বিন্দুমাত্র আগ্রহ প্রকাশিত না হলেও ভূমিকম্পকালে দুটি নয়নতারা গাছ রক্ষার তার অবিশ্বাস্য প্রয়াস দেখা গেছে। যদিও আবদুস সাত্তারের ইচ্ছাকৃত নয় এটি, বরং সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে এটা ছিল তার সহজাত বোধের অনিবার্য আচরণ। আর এই অনিবার্যতায় কলোনির মাটিতে প্রতিপালিত সব নয়নতারা গাছ মৃত্যুবরণ করে। কলোনিবাসী পুনরায় নয়নতারার চারা নতুনভাবে রোপণের প্রচেষ্টা চালালে সেগুলোর অকালমৃত্যু ঘটে। এছাড়াও তাদের উদ্যোগে কৃষি কলেজের এক অধ্যাপকের অধীনে নয়নতারার চারা বাঁচিয়ে রাখার মাসব্যাপী পরিশ্রমও অবশেষে ব্যর্থ হয়। জাদুবাস্তবতা এসব ঘটনার মূল ভিত্তি। অধ্যাপকের অনুসন্ধানে দেখা যায় যে, কলোনির যে স্থানে আবদুস সাত্তারের মস্তিষ্কের গলিত মগজ পতিত হয়েছিল, শুধু সে স্থানেই নতুন চারটি নয়নতারা গাছ জন্মেছে। তবে সেগুলোর কোনটিকে অন্যত্র সরানোর প্রচেষ্টা চালাতেই সেটি মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে এবং পূর্বের স্থানে ফিরিয়ে আনলে পুনরায় প্রাণবন্ত রূপ নিচ্ছে। এ ঘটনার অস্বাভাবিক ও অব্যাখ্যাত কার্য-কারণ সম্পর্কে অধ্যাপকের অনুমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে পূর্বোক্ত হলুদ প্রজাপতির উদ্দীপক ভূমিকা পালনের প্রসঙ্গ। কৃষি কলেজের অধ্যাপকের মতে, গাছগুলো আত্মহত্যা করেছে। তার বক্তব্য হল, ‘..আত্মহত্যার এই ইচ্ছে প্রথমে এক গাছ থেকে অন্য গাছে ছড়ায় গাছগুলোর নৈকট্যের কারণে এবং প্রজাপতি সম্ভবত এই প্রক্রিয়ায় মেসেঞ্জারের কাজ করেছে; পরে, আমার সন্দেহ হয়, মাটিরও কোনো এক ধরনের ভূমিকা থাকতে পারে। প্রজাপতির সংস্পর্শ এড়াতে পারলে এবং অন্যখান থেকে মাটি এনে গাছ লাগালে, আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা পুল গাছ হয়তো আবার হবে। আমি পলিথিনের ব্যাগের ভেতর একটি চারাকে এভাবে বাঁচাতে পেরেছিলাম। তবে, এভাবে এক্সপেরিমেন্ট করা যায়, বাগান করা যায় না।’ অধ্যাপকের এ বক্তব্য বাস্তবতা এড়িয়ে পরাবাস্তবতার দিকে অগ্রসর হয়, যেখানে সম্ভাবনা আর কার্য-কারণের সমীকরণে থেকে যায় অনিশ্চয়তা, সংশয় ও দ্বিধা। অর্থাৎ বিষয়টি বাস্তবে ঘটার সুযোগ না থাকলেও এড়িয়ে যাওয়া যায় না। পরবর্তীতে গণপূর্ত বিভাগ নতুন রাস্তা নির্মাণ ও জঞ্জাল নির্মূলের অংশ হিসেবে অবশিষ্ট গাছগুলো কাটায় আগারগাঁও কলোনি নয়নতারা গাছশূন্য হয়ে পড়ে।

নয়নতারা ফুল কেন নেই
বাংলাদেশে দেখা যায় এমন নয়নতারা (“Vinca Rosea”) উদ্ভিদ। ছবি: আমিনুল ইসলাম/সিসি-বাই-এসএ ৩.০

নয়নতারা গাছ রক্ষার জন্য আবদুস সাত্তারের মৃত্যুর ঘটনা ছিল একটি দুর্ঘটনা। শুধামাত্র তার মস্তিষ্কের গলিত স্থানে নয়নতারা গাছের বেচে থাকা এবং পূর্ববর্তী গাছসমূহের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে শহীদুল জহির বিশেষ ইঙ্গিত প্রকাশ করেছেন। গল্পে আকস্মিক ভূমিকম্পে জনজীবনের বিপর্যয়ের পর স্বৈরাচারী রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের পরিণতিতে সৃষ্ট সঙ্কট জাদুবাস্তবতা উঠে এসেছে। নয়নতারা গাছের আত্মহত্য মূলত উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক অবরুদ্ধতা অবস্থায় অবরুদ্ধ সংবেদনশীল মানুষের কোনমতে টিকে থাকার সুযোগকে উপেক্ষাপূর্বক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী অবস্থানে প্রতীকায়ন করে। আগারগাঁও কলোনি অন্যদিকে সামরিক শাসনের আশ্রয়স্থল তথা অবরুদ্ধ বাংলাদেশের রূপক। একই সাথে ভূমিকম্পকালে নয়নতারা গাছ রক্ষার প্রচেষ্টায় আবদুস সাত্তারের মৃত্যু এবং পরবর্তীতে কলোনিবাসীর উদ্যোগে নতুন নয়নতারা গাছ রোপণের ব্যর্থতা সমার্থক। গল্পে প্রকৃতি ও প্রেমের দারুণ উপমায় বাংলাদেশের একটি কঠিন সময়ের পরিস্থিতি উঠে এসেছে। আশির দশকের সামরিক শাসনের অভিঘাতে বাংলাদেশে জনজীবনের বিপন্নতার ভয়াবহ রূপকেই “আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই” গল্পে জাদুবাস্তবতার মাত্রায় তুলে ধরেছেন শহীদুল জহির।

Loading

Scroll to Top