Robben Island by Frans Lemmens

নেলসন ম্যান্ডেলার রোবেন দ্বীপ

প্রতিদিন পৃথিবীর অসংখ পর্যটক নৌযানে করে নেলসন ম্যান্ডেলার রোবেন দ্বীপে ঘুরতে আসেন। আর তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে ম্যান্ডেলার বন্দিশালা। রোবেন দ্বীপ জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে পর্যটকদের বাসে করে ঘুরিয়ে দেখানো হয় পুরো দ্বীপাঞ্চল। আর সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগারের সংরক্ষিত বিভিন্ন বন্দীর দলিল-দস্তাবেজ ও ঐতিহাসিক স্থানসমূহ। এখানে ঘুরতে এসেছিলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন, বারাক ওবামা-সহ অনেক বিখ্যাতরা।

নেলসন ম্যান্ডেলার রোবেন দ্বীপ
রোবেন দ্বীপ থেকে টেবিল পর্বতের দৃশ্য। ছবি: লেখক/সিসি-বাই-এসএ ৪.০

প্রাথমিকভাবে সামুদ্রিক জাতের পাখি, আফ্রিকান পেঙ্গুইন, সিল এবং কচ্ছপসহ বিভিন্ন প্রাণী-জীবনের অধ্যুষিত অঞ্চল ছিলো দক্ষিণ আটলান্টিকের রোবেন দ্বীপ, আফ্রিকানরা যাকে বলে “রোবেনিল্যান্ড”। দক্ষিণ আফ্রিকার পশ্চিম কেপ প্রদেশের ব্লাবার্গস্ট্যান্ড (Bloubergstrand) উপকূল থেকে প্রায় ৬.৯ কিলোমিটার এবং কেপ টাউন পোতাশ্রয় থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে আটলান্টিকের টেবিল উপসাগরে এই উপবৃত্তাকার দ্বীপের অবস্থান।

রোবেন শব্দটি ওলন্দাজ ভাষাভাষী মানুষের কাছ থেকে এসেছে, যার অর্থ “সিল” আর তা থেকেই দ্বিপটির নাম হয়েছে “সিল দ্বীপ”। প্রাচীন ক্ষয়সাধনের ঘটনার ফলে দ্বীপটি সমতল এবং সমুদ্রতল থেকে মাত্র কয়েক মিটার উপরে দৃষ্টিনন্দন বিদ্যমান। প্রাথমিকভাবে কৃষিকাজে ব্যবহৃত হলেও পরবর্তীতে দ্বীপটি ক্রীতদাসদের জন্য নির্ধারিত হয়। যদিও দ্বীপটি এখন আর কোনো বিনোদন রিসোর্ট নয়। ঔপনিবেশিক আমলে, সতেরো শতক থেকে প্রায় ৪০০ বছর ধরে কারাবাস, নির্বাসন এবং বিচ্ছিন্নতার স্থান হিসেবে- বিশেষ করে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ বন্দিদের নির্বাসন ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতাদের নির্বাসনের জন্য ব্যবহৃত দ্বীপটি এখন নিস্ক্রিয় কারাগার হিসেবেই পরিচিত।

প্রাচীনযুগে দ্বীপটি, মূলত পর্বতের প্রান্ত হিসেবে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিল। সর্বশেষ বরফ যুগের প্রায় ১২ হাজার বছর পূর্বে, ক্রমবর্ধমান সমুদ্রস্তর উপকূল থেকে দ্বীপটি পৃথক করে। ১৫০০ শতকের প্রথমার্ধেও পৃথিবীবাসীর কাছে রোবেন দ্বীপটি অজানা ছিল। ১৪৮৮ সালে পর্তুগিজ পর্যটক বাতোলোমিও ডায়াস টেবিল উপসাগরে জাহাজ নোঙর করার সময় দ্বীপটির অস্তিত্ব খুঁজে পান।

নেলসন ম্যান্ডেলার রোবেন দ্বীপ
ইয়োহান মুলম্যান নির্মিত অশতুমাতোর ভাস্কর্য। ছবি: Ladylebz

সতেরো শতাব্দীর শেষের দিকে ত্তলন্দাজরা কেপ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করতে আসে এবং শীঘ্রই দ্বীপটিকে কারাগার হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করে তারা- যার সক্রিয়তা ১৯৯১ সাল পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। সে সময়ে এটির প্রথম বন্দী ছিল সম্ভবত স্ট্র্যান্ডলপার নেতা অশতুমাতো (Autshumato)।

উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বিভিন্ন জাতির আফ্রিকান নেতারা এই দ্বীপে নির্বাসিত হয়েছিল। পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের ওলন্দাজ উপনিবেশ থেকে ঔপনিবেশিক সৈন্য ও বেসামরিকদের মতোন মুসলিম নেতাদেরও এখানে কারারুদ্ধ করা হয়। অন্যদিকে অনেককে মিথ্যা অপরাধে অভিযুক্ত করে এবং অনেককে সম্পূর্ণ বিনা অপরাধেই এখানে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল।

উনিশ শতাব্দীতে, মানসিক অসুস্থতা এবং কুষ্ঠ বন্দিদের নিঃসঙ্গ করে তোলে, কারণ দ্বীপের জলবায়ু স্বাস্থ্যকর বলে মনে করা সত্বেও বড় আকারের সমাজ থেকে দূরে তাদের এখানে বন্দি রাখা হয়েছিল। ১৯৩১ সালের শেষের দিকে দ্বীপে একটি সম্প্রদায়ের মধ্যে কুষ্ঠরোগীদের সীমাবদ্ধ করা হয়।

রোবেন দ্বীপের সবচেয়ে মর্মান্তিক সময়ের শুরু হয় বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে, যখন এটি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের রাজনৈতিক বন্দীদের জন্য সর্বাধিক নিরাপত্তার কারাগার হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালের শুরুতে কৃষ্ণাঙ্গ, ভারতীয় এবং মিশ্রজাতির বেশিরভাগ বন্দিদের এখানে পাঠানো হয়, যাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদী নেতা (পরবর্তীতে দেশটির রাষ্ট্রপতি) নেলসন ম্যান্ডেলাও ছিলেন, যিনি রোবেন দ্বীপের কারাগারে তার জীবনের ১৮ বছর (১৯৬৪-১৯৮২) কাটিয়েছেন। কারাবাসের বিভিন্ন ঘটনা তিনি ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত আত্মজীবনীমূলক “অ্যা লং ওয়াক টু ফ্রিডম” গ্রন্থে লিখেছেন।

নেলসন ম্যান্ডেলার রোবেন দ্বীপ
এই বিছানাহীন কক্ষে ম্যান্ডেলা ১৮ বছর অন্তরীণ ছিলেন। ছবি: লেখক

১৯৬৪ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত দ্বীপে স্থানান্তরিত বন্দিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণই ছিল ম্যান্ডেলার ভাবশিষ্য। যার কারনে দ্বীপটির আরেক আদির্শক নাম হয়ে দাঁড়ায় ‘ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয়’। দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী ও মুক্তিসংগ্রামের অনেক নেতাকেই বিভিন্ন সময় এই দ্বীপে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল, যাদের মধ্যে কগলেমা মোথল্যাথে (Kgalema Motlanthe) ও জ্যাকব জুমা উল্লেখযোগ্য, যারা দুজনই পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।

উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার (২.১ মাইল) দৈর্ঘ্যের ও ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার (১.২ মাইল) প্রস্থের প্রায় ৫ দশমিক ০৮ কিলোমিটার (১.৯৬ বর্গমাইল) এলাকার ক্ষুদ্র দ্বীপ দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।

দক্ষিণ আফ্রিকার নিরীক্ষক জেনারেল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় ঐতিহ্যবাহী স্থান ও আফ্রিকার ইতিহাসের অনন্য এই দ্বীপ সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেন। ১৯৯৯ সালের পর থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার রোবেন দ্বীপের বন্দিশালাকে দেশের অন্যতম জাতীয় জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা দেয়। একই বছর দ্বীপটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় যুক্ত হয়।

কীভাবে ঘুরবেন: দ্বীপে ভ্রমণ মূলত রোবেন দ্বীপ জাদুঘর দ্বারা পরিচালিত হয়, যা এই স্থানটির তত্ত্বাবধান করে। এখানকার বর্তমান অনেক গাইডই প্রাক্তন রাজনৈতিক বন্দি ছিলেন যারা এখানে তুলনামূলক কম সুখী পরিস্থিতির মধ্যেই গাইডের কাজ পরিচালনা করছেন। প্রকৃতপক্ষে যাদের উপস্থিতি রোবেন দ্বীপের ইতিহাস পুনরজ্জীবীত করে তোলে। প্রায় সাড়ে ৫ কিলোমিটারের দ্বীপটি সহজেই হেঁটে বেড়ানো যায়। তবে ভ্রমণের অংশ হিসেবে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ একাধিক ট্যুর বাস পরিচালনা করে।

রোবেন দ্বীপ জাদুঘর পরিচালিত ভ্রমণের অংশ হিসেবে দ্বীপের কবরস্থান, রবার্ট সোবকুয়ের বাড়ি, চুন ও নীলপাথরের খনি, সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনীর বাংকার, এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগারের নেলসন ম্যান্ডেলার কক্ষ অন্তর্ভুক্ত। এর বাইরেও ঘুরে দেখা যেতে পারে:

মতুরো ক্রামোত দ্বীপে মুসলিম তীর্থযাত্রার এক ধর্মীয়-স্থান যা কেপ টাউনের প্রথম ইমাম, মাদুরার যুবরাজ সাঈদ আব্দুরহমান মতুরো স্মরণে নির্মিত হয়েছিল। এটি মূলত আব্দুরহমান মতুরোর সমাধি।

স্যার হার্বার্ট বেকার কর্তৃক পরিকল্পিত পুরুষ কুষ্ঠরোগীদের জন্য নির্মিত গুড শেফার্ড গির্জা দক্ষিণ আফ্রিকার অ্যাঙ্গলিয় গির্জার মালিকানাধীন এবং দ্বীপের একমাত্র ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ভবন।

দক্ষিণ আফ্রিকার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই আন্তঃদেশীয় (পূর্ব অ্যাঙ্গলিয়) গ্যারিসন গির্জায় প্রতিবছর ভালোবাসা দিবসে গণবিবাহ আয়োজিত হয়।

বাতিঘরটি দ্বীপের সর্বোচ্চ উঁচু স্থান মিন্টু পাহাড়ে অবস্থিত। ১৬৫০-এর দশকে কেপ টাউনের প্রথম ওলন্দাজ ঔপনিবেশিক প্রশাসক জেন ভ্যান রাইবেইক নৌবাহিনীর জাহাজের চূড়ান্ত সামুদ্রিক বিপদের কারণে দ্বীপের সর্বোচ্চ পর্বতমালায় আগুন জ্বালানোর নির্দেশ দিতেন। পরবর্তীতে ১৮৬৫ সালে এই স্থানে বাতিঘরটির কাজ সম্পন্ন করা হয়। ১৮ মিটার (৫৯ ফুট) উচ্চতার এই নলাকার-চক্রাকার মিনারের মাথায় রয়েছে একটি লণ্ঠন আর নিচে একটি সংযুক্ত লণ্ঠন-রক্ষাকারী ঘর। ১৯৩৮ সাল থেকে বাতিঘরে বিদ্যুত  সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। বাতিঘরে ঘূর্ণন বাতির পরিবর্তে একটি ঝলকানি লণ্ঠন ব্যবহার করা হয় যেটি প্রতি সাত সেকেন্ড অন্তর ৫ সেকেন্ড সময়ের জন্যে জ্জ্বলে ওঠে। ৪৬,০০০-ক্যান্ডেলার এই মরীচি সাদা আলো ২৪ নটিক্যাল মাইল (২৮ মাইল বা ৪৪ কিমি) পর্যন্ত দৃশ্যমান যা দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বগামী জাহাজগুলোর ন্যাভিগেশন সহায়ক হিসেবে দ্বিতীয় লাল আলোর কাজ করে।

কখন, কীভাবে যাবেন

পর্যটকদের জন্য দ্বীপটি সারা বছর উন্মুক্ত রাখা হয়, যদিও শীতকালে আবহাওয়ার কারণে ফেরি চলাচল প্রায়ই শীথিল রাখা হয় এবং সন্ধ্যার আগেই বন্ধ হয়ে যায়।

সীমিত সুবিধা এবং সংরক্ষণ প্রচেষ্টার কারণে দ্বীপে দৈনিক ভ্রমণকারীর সংখ্যা ১৮০০ জনে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। দ্বীপে ভ্রমণের সময়ের দুই সপ্তাহ আগে থেকে অগ্রীম টিকেট ছাড়া হয়। আর প্রচুর সংখ্যক লোক এখানে নিয়মিত ঘুরতে আসে বলে অগ্রীম টিকেট বুক করে নেয়া সুবিধাজনক। যাতায়াত এবং ভ্রমণের জন্যে সবমিলিয়ে আনুমানিক চার-পাচ ঘন্টা ব্যয় করলেই সাচ্ছন্দভাবে ঘুরে আসা যায় রোবেন দ্বীপ।

কেপ টাউনের ভিক্টোরিয়া ও আলফ্রেড ওয়াটারফ্রন্টের (V&A Waterfront) ম্যান্ডেলা গেটওয়ে থেকে পুরো সপ্তাহ জুড়ে বেলা তিন বার (সকাল ৯টায়, ১১টায় ও দুপুর ১টায়) একাধিক ফেরি দ্বীপের দিকে যাত্রা করে। স্বাভাবিক আবহাওয়ায় দ্বীপে পৌছাতে প্রায় ৩০ মিনিট সময় লাগে। রোবেন দ্বীপ জাদুঘর ওয়েবসাইটের (http://www.robben-island.org.za/) মাধ্যমে অনলাইনে এই টিকেট বুক করা যায়। টিকেটের মূল্য প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ৩৬০ র‌্যান্ড (বাংলাদেশি টাকায় ২১০০-২৩০০, ২০১৮ সাল অনুযায়ী) ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১৮০ র‌্যান্ড  (বাংলাদেশি টাকায় ১১০০-১৩০০, ২০১৮ সাল অনুযায়ী)।

প্রতিদিন অনেকেই হেলিকপ্টারে চড়েও দ্বীপে ঘুরতে আসনে। এতে একজনের খরচ হতে পারে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার থেকে ১৫ হাজার (২০১৮ সাল অনুযায়ী)।

প্রচ্ছদ ছবি: ফ্রান্স লেমেনস/গেটি ইমেজেস


পূর্বে প্রকাশিত: জার্নি প্রচ্ছদ | বাংলা ট্রিবিউন | ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৮


আরো পড়ৃন: বোল্ডার্সে আফ্রিকান পেঙ্গুইনের মুখোমুখি

Loading

Scroll to Top